বিতর্কের শুরুতেই প্রস্তাবটি পেশ করে পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় আলোচনার ধারা বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা করেন৷ তিনি বলেন, 'বিবিধের মাঝে মিলন আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে৷' কিন্ত্ত প্রস্তাবে 'রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতারও' উল্লেখ থাকায় বামেদের তরফে প্রথম বক্তা আরএসপির সুভাষ নস্কর আলোচনার ধারাকে সেই দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন৷ শুরুতে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গ টানলেও মসৃণ ভাবেই তিনি ঢুকে পড়েন এ রাজ্যে বিরোধীদের প্রতি শাসকপক্ষের 'অহিষ্ণুতার' প্রশ্নে৷ সুভাষবাবু বলেন, 'বলতে বাধ্য হচ্ছি, এখন সরকারপক্ষ এবং বিরোধীপক্ষ এই ভাবে সবকিছু দেখা হচ্ছে৷ কেন বলতে পারি না, আমরা সবাই এই দেশের? মুখ্যমন্ত্রী বিরোধীদের প্রশ্নের জবাব দিতে এখানে আসেন না৷ এটা কি রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতা নয়? কেন মুখ্যমন্ত্রীকে কেউ প্রশ্ন করলে তাঁকে মাওবাদী বলা হবে?' তৃণমূলের 'অন্তর্দলীয় অসহিষ্ণুতা' প্রতিপন্ন করতে তিনি বলেন, 'কেন চিট ফান্ডের জন্য সিবিআই কাউকে ডাকলেই তাঁকে পদ থেকে অপসারিত হতে হবে?' এর পর আর সহ্য হয়নি সরকারপক্ষের৷ সভায় হইহই জুড়ে দেয় ট্রেজারি বেঞ্চ৷ কিন্ত্ত তাতেও না-দমে সুভাষবাবু বলে চলেন, 'অতিসহিষ্ণুতাও ভালো নয়৷' প্রকাশ্যে গোমাংস খাওয়ার সমালোচনা করে তিনি নাম না-করে বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের দিকে ইঙ্গিত করেন৷ আবার 'নামাজিদের সঙ্গে নামাজ পড়ার' নজির টেনে কটাক্ষ করেন তৃণমূলনেত্রীকে৷
পরবর্তী বক্তা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় আলোচনার সুর ফের ঘুরিয়ে দিয়ে উগ্র হিন্দুত্বের সমালোচনায় চলে যান৷ সভার মধ্যেই পিতৃতর্পণের মন্ত্রোচ্চারণ করে এই প্রবীণ বিধায়ক ব্যাখ্যা করেন, এই মন্ত্রে পৃথিবীর সমস্ত তৃষ্ণার্তের মুখে জল দেওয়ার অঙ্গীকার আছে৷ উদার হিন্দু ধর্ম 'ঘর ওয়াপসি'র কথা মোটেই শেখায় না বলে ব্যাখ্যা দেন শোভনদেব৷ তৃণমূলের তাপস রায় আশঙ্কা প্রকাশ করেন, দেশে এই অসহিষ্ণুতার পরিবেশের জেরে বিদেশে থাকা ১ কোটি ৬৫ লক্ষ ভারতীয় বংশোদ্ভূতও বিপন্ন৷কিন্ত্ত বামেদের তরফে পরেশ অধিকারীর মতো বিধায়ক ফের মমতাকে বিঁধে অভিযোগ করেন, 'পালাবদলের পর রাজ্যে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা মাথাচাড়া দিয়েছে৷' উদাহরণ হিসেবে পার্ক স্ট্রিট গণধর্ষণের ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর প্রথম প্রতিক্রিয়া, কামদুনির ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা, জঙ্গলমহলের শিলাদিত্য চৌধুরীর পরিণতির প্রসঙ্গ সভায় উত্থাপন করেন তিনি৷ কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়াও কটাক্ষের সুরে বলেন, 'কাল মালদহে মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনে ভালো লাগল৷ তা হলে উনি অবশেষে বুঝেছেন যে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা থাকা উচিত নয়৷' তবে কম-বেশি সব বক্তাই আরএসএস এবং উগ্র হিন্দুত্ব প্রসঙ্গে শমীকবাবুর দল ও প্রধানমন্ত্রীকে ক্রমাগত কাঠগড়ায় তোলেন৷ আবার চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য ফেলানি বসাকের প্রসঙ্গ তুলে বাম বিধায়কদের কটাক্ষের জবাব দেন৷
বামফ্রন্টের অন্য বক্তারা রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার প্রশ্নে তৃণমূলকে আগেই বেঁধায় বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র খুব বেশি আক্রমণাত্মক হননি৷ সৌজন্য বজায় রেখে বক্তৃতার শুরুতে তিনি শুধু বলেন, 'হ্যাঁ, রাজ্যে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা আছে৷ গণতন্ত্র যদি আক্রান্ত হয়, ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে লড়াই আপনারা এগোতে পারবেন না৷' পরিশেষে প্রস্তাবের উপর বলতে উঠে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের শ্লেষ, 'কেউ কেউ একটু অসহিষ্ণু হয়ে উঠে প্রস্তাবের আলোচনায় চোনা ফেলে দিলেন৷ আমি যখন সূর্যবাবুর জায়গায় (বিরোধী দলনেতার আসন) বসতাম, আমারও মনে হত ওঁরা কত অসহিষ্ণু৷ আপনাদের তো সহিষ্ণু সরকার ছিল, তাই নন্দীগ্রাম-নেতাই ঘটেছিল৷ শর্টকাটে ক্ষমতায় ফেরার জন্যই অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছেন অনেকে৷' ১৯৯১-এর ৩১ মার্চ সহিষ্ণুতা নিয়ে জ্যোতি বসুর একটি স্মরণীয় বক্তৃতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে পার্থ চট্টোপাধ্যায় আক্ষেপ করেন, পরবর্তীকালে বামেরা তা হাতে-কলমে বজায় রাখতে পারেনি৷
এই সময়: বিতর্কসভা অসহিষ্ণু হয়ে ওঠার রসদ ছিল সর্বদলীয় প্রস্তাবেই৷ কিন্ত্ত বুধবার রাজ্য বিধানসভায় শাসক-বিরোধী দু'পক্ষই যথাসাধ্য সহিষ্ণুতা বজায় রেখেই অসহিষ্ণুতার উপর আলোচনা সারল৷ রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার প্রশ্নে বাম-তৃণমূল পরস্পরকে দুষেছে ঠিকই৷ কিন্ত্ত এই বিষয়ে দু'পক্ষের হাতেই পরস্পরকে কাঠগড়ায় তোলার অজস্র নজির থাকায় আগ্রাসনের মাত্রা কাদা ছোড়াছুড়ির জায়গায় পৌঁছনোর আগেই রাশ টেনেছেন বক্তারা৷ প্রস্তাবে সই না-করলেও বাম-কংগ্রেস-তৃণমূলের সম্মিলিত আক্রমণ প্রতিহত করতে মরিয়া লড়াই করতে হয়েছে বিজেপির একমাত্র বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যকে৷ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলেও, বাস্তবে তার প্রয়োগ কত দূর সম্ভব তা অবশ্য বিধানসভা ভোটের আগেই স্পষ্ট হয়ে যাবে৷