শেষ পর্যন্ত শহর চিনল সেলিম বায়োস্কোপওয়ালাকে৷ শুক্রবারের পড়ন্ত বেলার কনে দেখা আলোয় নন্দন চত্বরে চলচ্চিত্র উত্সবে সিনেমা রসিকদের ভিড় ভেঙে পড়েছিল তাঁকে ঘিরে৷ এ দিন বিকেলে রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি সচিব অত্রি ভট্টাচার্য নন্দন এক প্রেক্ষাগৃহের দোরগোড়ায় সাংবাদিকদের কাছে মহম্মদ সেলিমের পরিচয় করে দিয়েছেন দেশের 'শেষ ' বায়োস্কোপওয়ালা হিসাবে৷ দেশ -বিদেশের প্রতিনিধি ও দর্শকদের উছ্বাসের পাশাপাশি সেলিমের মন ভরেছে আজ , শনিবার নজরুল মঞ্চে চলচ্চিত্র উত্সবের সমান্তি উত্সবে সরকারি সংবর্ধনার প্রতিশ্রীতিতেও৷ সরকারের আর্থিক সহায়তার আশ্বাসও পেয়েছেন তিনি৷ হাতে চালানো যে প্রাচীন প্রজেক্টরে পথে পথে বায়োস্কোপ দেখিয়ে কলাবাগান বস্তির ঘুপচি ঘরে পরিবারের অন্নসংস্থান করেছেন সেলিম , সসম্মানে সেই যন্ত্রটি কলকাতায় প্রস্তাবিত ফিল্ম মিউজিয়াম ও আর্কাইভসে ঠাঁই পাবে বলেও জানিয়েছেন অত্রিবাবু৷
এত দিন শহরের অলিগলিতে নীল ঠেলাগাড়ি ঠেলতে ঠেলতে চলা এই মানুষটিকেই মানুষ প্রথম দর্শনে ভুল করতেন নেহাত সাদামাটা ফেরিওয়ালা হিসাবে৷ বুড়ো মানুষটি গাড়িটির উপর হাতল লাগানো মেশিন ঘুরিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ বার করতেই লোকজন খানিক থমকে যেতেন৷ চমকের উপর চমক , গাড়িটির ঘুপচিতে কালো চাদরের আড়ালে চোখ রাখলে যে দেখা যায় হিন্দি , বাংলা বাম্পার হিট সব ছবি৷ পাড়ায় পাড়ায় রব উঠত , আরে এ যে বায়োস্কোপওয়ালা ! কিন্ত্ত এত করেও কলকাতায় বিশেষ কল্কে পাননি 'সেলিমবাবা '৷ অথচ তাঁকে নিয়ে মার্কিন পরিচালক টিমোথি স্টার্নবার্গের বানানো তথ্যচিত্র শুধু অস্কারের মনোনয়ন নয় , সারা বিশ্বের ১৬টি ফিল্ম উত্সবে আদৃত হয়েছিল৷ শেষমেশ সরকারি সহায়তায় এ দিন নন্দনে হাজির হওয়ার সুযোগ পেয়ে প্রথম বল থেকেই দেদার ছক্কা হাঁকালেন সেলিম৷ তাঁর একশো বছরের পুরোনো , আজকের ডিজিট্যাল প্রযুক্তির নিরিখে প্রায় প্রাগৈতিহাসিক , হাতে চালানো প্রজেক্টরে সিনেমা দেখতে ভেঙে পড়ল আট থেকে আশির ভিড়৷
সাতাত্তর বছরের মার্কিন চিত্রপরিচালক ও সমালোচক লায়েল পিয়ারসন ১৯৭৪ সাল থেকে ভারতীয় ছবির বিশ্লেষণ করছেন৷ সেই সাহেবও মাটিতে উবু হয়ে বসে কালো কাপড়ে মাথা ঢেকে ছবির খানিকটা দেখে বললেন , 'দিস মেশিন রিমাইন্ডস মি অফ আ সিমিলার ওয়ান ইন সত্যজিত্ রে 'জ পথের পাঁচালী৷ ' আসলে যন্ত্রটি দেখে সাহেবের 'পথের পাঁচালী 'তে অপুর বায়োস্কোপের বাক্সে চোখ রাখার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল৷ আবার নন্দনে ছবি দেখতে এসে হাওড়ার সুরজিত্ সাহু বা মেটিয়াবুরুজের অমল মণ্ডলের এটাই ছিল বাড়তি পাওনা৷ একই প্রতিক্রিয়া কলেজ ছাত্র অনির্বাণ চক্রবর্তীরও৷ তবে একসময় ভিড়ের চাপে সেলিমের দুই ছেলে জসিম ও আসগার বাবাকে বলেই ফেললেন , ' আব্বা , ফিল্ম দিখানা বন্ধ কর দিজিয়ে৷ নহি তো মেশিন গির জায়েগা৷ ' কিন্ত্ত , ছেলেদের কথায় কান না দিয়েই সেলিম হাসিমুখে অক্লান্ত হাতে প্রজেক্টর চালিয়ে দেখিয়ে চললেন 'খলনায়ক ', 'জান বা 'চেন্নাই এক্সপ্রেস '-এর মতো ছবি৷ এ দিন বেলা বারোটার আগেই অত্রিবাবু ও চলচ্চিত্র উত্সবের অন্যতম কর্মকর্তা অরিন্দম শীলের একান্ত প্রয়াসে মহাজাতি সদনের গলিতে পৌঁছে গিয়েছিল সরকারি গাড়ি৷ জসিম তত ক্ষণে কোমর বেেঁধে নেমে পড়েছেন ভ্যানগাড়িটি সাফসুতরো করতে৷ কালো কাপড় ও স্ক্রিনের জোগাড়যন্ত্র , সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে ভ্যানে প্রজেক্টর বসানোর জোগাড়যন্ত্রের মাঝে সেলিম সেরে এলেন জুম্মাবারের নমাজ৷ ধোপদুরস্ত শার্ট আর সাদা ধুতি পরে ছেলেদের নিয়ে উঠলেন গাড়িতে৷ বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজনের পর্বটি বাদ পড়ল তিন জনেরই৷ তবে , 'শো '-তে বেরিয়ে খিদে -তেষ্টা যে বায়োস্কোপওয়ালার গায়ে মাখলে চলে না , তা-ও পরিষ্কার জানালেন সেলিম৷ অত্রিবাবু ও অরিন্দমবাবু সেলিম বায়োস্কোপওয়ালাকে সম্মান জানিয়ে বিশেষ সাংবাদিক বৈঠকেরও আয়োজন করেছিলেন৷ সেখানে সেলিম বলেন , 'পাঁচ লাখ টাকায় আমেরিকানরা আমার কাছ থেকে এই যন্ত্র কিনতে চেয়েছিল৷ আমি বাংলার সম্পদ বিক্রি করতে চাইনি৷ একবার ইচ্ছা হয় মুখ্যমন্ত্রীর দেখা পেতে৷ ' অরিন্দমবাবুর মতে , 'চলচ্চিত্র যে কারও কারও জীবনে প্যাশন হয়ে ওঠে , তা বোঝা যায় এই মানুষটিকে দেখে৷ অভাব -রোদ -ঝড় -বৃষ্টি --- সব মাথায় নিয়ে সেলিম চার দশক ধরে বায়োস্কোপ দেখিয়ে যাচ্ছেন৷ ' অত্রিবাবুর কথায় , 'উনি বলছিলেন , যে কদিন বাঁচবেন , যেন বায়স্কোপ দেখাতে পারেন৷ আমরা সেই সুযোগ তাঁকে দিতে চাই৷ ' সব মিলিয়ে , এত দিন পর কলকাতার মন জিতে ভবিষ্যতের এক রঙিন স্বপ্ন নিয়েই ঘরে ফিরলেন শহরের এই নিঃসঙ্গ ফেরিওয়ালা৷
পার্থসারথি সেনগুপ্ত