Amartya.Mukherjee@timesgroup.com
হ্যাঁ, যুদ্ধই বটে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্বের সাইরেন-ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রস্তাবিত প্রকল্পের সংক্ষিপ্ত নামই তো 'ওয়ার্স' (WARS): 'ওয়্যারলেস অটোমেটেড রিমোট সিস্টেম'৷ বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তর বা সিভিল ডিফেন্স-এর তরফে রাজ্য সরকারের কাছে গত বছর ওয়ার্স-এর প্রস্তাব দেওয়া হলেও এখনও সেই আধুনিক ভোঁ-ধ্বনি শোনেনি এই শহর৷ বৃহস্পতিবার বিপর্যয়ে উদ্ধার কাজের মহড়ার সময় 'নকল' বিপর্যয়ের বার্তা দিতে আধ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে খোদ মহাকরণের৷ হেস্টিংস-এর মহিলা বিএড কলেজ, শপিং মলেও বাজেনি সাইরেন৷
প্রশাসন সূত্রে জানা খবর: বৃহস্পতিবারের মহড়ায় বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের যে কর্মীরা ছিলেন, তাঁদের ময়নাতদন্তে উঠে এসেছে তিনটি বিষয়: (১) বিভিন্ন শাখার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, (২) সাউন্ডহেলার-এর ব্যাটারি 'ডাউন' এবং (৩) আধুনিক যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য আরও প্রশিক্ষণ দরকার কর্মীদের৷
বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের ডিরেক্টর গঙ্গেশ্বর সিং শুক্রবার বলেন, 'বিপদবার্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে সাইরেন-ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ কার্যত বিলুপ্ত সেই ব্যবস্থা ফিরিয়ে আমার জন্যই অত্যাধুনিক ওয়ার্স-এর ভাবনা৷ প্রস্তাব অনুযায়ী কলকাতা, সুন্দরবন এবং ডিভিসি-র হিসেবে প্লাবনসঙ্কুল এলাকাগুলিতে এই স্বয়ংক্রিয় সাইরেন-ব্যবস্থা চালু করার কথা৷ কলকাতার মূল কন্ট্রোল রুম এবং ছ'টি সাব-কন্ট্রোল রুমের সাহায্যে কলকাতা, ডায়মন্ড হারবার, ক্যানিং, কাঁথি, হলদিয়া ও ডিভিসি এলাকায় এই 'ভিপিএন টিসিপি/আইপি কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক' কাজ করবে৷' দপ্তরের মন্ত্রী জাভেদ খানকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, 'খোঁজ না নিয়ে বলা উচিত নয় এই প্রস্তাব কি অবস্থায় রয়েছে৷'
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি বোমারু বিমানের অতর্কিত বোমা-হানার আগাম বার্তা দিতেই 'কু'খ্যাত হয় সাইরেন-ব্যবস্থা৷ ১৯৬২-তে ভারত-চিন যুদ্ধের সময়ও শহরের কানে এসে পৌঁছত এই ভোঁ-বার্তা৷ কিন্ত্ত কালের নিয়মে যুদ্ধহীন শহরে ধীরে-ধীরে অবলুপ্তির পথে এগিয়েছে সাইরেন-ধ্বনি৷ ওয়ার্স-এর প্রস্তাবেই বলা আছে, কলকাতা ও তার সংলগ্ন এলাকায় একসময় দু'শোরও বেশি সাইরেন-সাইট ছিল৷ যুদ্ধ না-হলেও বিপর্যয় মোকাবিলার দেশব্যাপী নতুন সংজ্ঞা নিরূপণে প্রশাসন তত্পর হয় সুনামি-পরবর্তী অধ্যায়ে নতুন করে৷ এ রাজ্যে আয়লার পর বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের জন্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের 'সেন্টার ফর ডিস্ট্রিবিউটেড কম্পিউটিং' একটি সমীক্ষা করে৷ মূলত তার ভিত্তিতেই মূল কন্ট্রোল রুম ও জেলা কন্ট্রোল রুমের সাহায্যে 'ইমার্জেন্সি ওয়ার্নিং সিস্টেম' তৈরির ভাবনা শুরু৷
প্রশাসন সূত্রে খবর: প্রাথমিক ভাবে ৮১/২২/১ ফিয়ার্স লেনে বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের যে অফিস রয়েছে, সেখানেই মূল কন্ট্রোল রুম তৈরি হওয়ার কথা৷ এখন যে কন্ট্রোল রুম ওই ঠিকানায় রয়েছে, তার গায়ে অবশ্য সেই আধুনিকতার লেশমাত্র পড়েনি এখনও৷ এই কন্ট্রোল রুম-এর মাধ্যমেই গোটা রাজ্যের সাইরেন-ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কথা৷ শহরে (থানা, পুরসভার ওয়ার্ড-অফিস, বরো অফিস, অন্যান্য সরকারি ভবন)-র সীমানা ছাড়িয়ে জেলায় পঞ্চায়েত অফিসে সাব-কন্ট্রোল রুম তৈরি করার প্রস্তাব দেওয়া আছে৷ শহরের দ্বিতীয় সাব-কন্ট্রোল সেন্টার এবং সাইরেন-সাইটের সঙ্গে যোগযোগ বজায় রাখবে মূল কন্ট্রোল রুম৷ মূল কন্ট্রোল রুম-এর সঙ্গে সাব-কন্ট্রোল সেন্টারের যোগাযোগ রাখা হবে 'আইপি লিজড লাইন'-এর মাধ্যমে৷ অন্যদিকে, সাব-কন্ট্রোল সেন্টার এবং সাইরেন-সাইটগুলি একে-অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে 'ভিএইচএফ রেডিও নেটওয়ার্ক'-এর মাধ্যমে৷ অর্থাত্ ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে শহর যেমন মুহূর্তের মধ্যে বিপদসঙ্গেত বাজাতে পারবে, তেমনই সেই ক্ষমতা থাকবে জেলাগুলিতেও৷
রিমোট সাইরেন-সাইটগুলিতে যা থাকার কথা, তা হল: (১) ইলেকট্রনিক সাইরেন, (২) অ্যান্টেনা-সহ ভিএইচএফ রেডিও ট্রানসিভার যা রিমোট-সাইট যন্ত্রগুলির জন্য প্রয়োজনীয়, (৩) হাই-ক্যাপাসিটি মেনন্টেন্যান্স ফ্রি ব্যাটারি, (৪) সোলার পাওয়ার সোর্স যা আসলে দ্বিতীয় ব্যাক-আপ এবং (৫) ১৫ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট অ্যান্টনা৷ তিনটি ধাপে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত করার কথা রাজ্যের৷ প্রথম পর্বের জন্য ৪ কোটি ২৯ লক্ষ টাকা ও দ্বিতীয় পর্বের জন্য ৫ কোটি ৯৭ লক্ষ টাকার ব্যয়বরাদ্দ ধার্য করা হয়েছে৷ কলকাতা পুরসভার এলাকাভুক্ত ২৮টি জায়গায় ওয়ার্স রিমোট-সাইট তৈরি করার কথা৷ দ্বিতীয় পর্বে কলকাতার আরও ৩২টি জায়গাকে চিহ্নিত করা হবে৷
যুদ্ধের প্রস্ত্ততিতে পাল্টা 'যুদ্ধ'৷ তবু শহরের কানে পৌঁছয় না দ্বিতীয় সেই যুদ্ধের 'ভোঁ-ও-ও-ও'৷ বিপর্যয় মোকাবিলায় বৃহস্পতিবার যে মক ড্রিল দেখল কলকাতা, তাতে সাইরেন-বার্তার দুরবস্থা উদ্বেগ বাড়িয়েছে নগর-প্রশাসনের৷ অথচ মৃত সাইরেন-ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনে কার্যত ফাইলবন্দি হয়েই পড়ে 'যুদ্ধ'৷