বেশ কয়েক বছর কাটল৷ তখন ২০১৪৷ সেই ছেলেটির বয়স ২৬৷ সে একটি ভিডিয়ো প্রকাশ করে বলল, 'সারা জীবন শুধু মুসলিমদের রক্ত ঝরতে দেখলাম৷ প্রার্থনা করি, যারা আল্লার বিরোধিতা করবে তাঁর অনুগত সেনা ও অনুগামীরা তাদের নিকেশ করে ছাড়বে৷'
সেই স্কুল ছাত্রই আজকের আবদেলহামিদ আবাউদ৷ প্যারিসে ভয়াবহ জঙ্গি হানার সম্ভাব্য মূল চক্রী৷ নিকেশ করার নেশা তার দিন দিন বাড়তে থাকে৷ সে বাড়াবাড়ি এমন জায়গায় পৌঁছয় যে, গত বছর যখন গুজব ছড়িয়েছিল যে সিরিয়ায় আবাউদ নিহত হয়েছে, অন্যদের সঙ্গে স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিল তার পরিবারও৷ আবাউদের বড়দিদি ইয়াসমিন বলেছিলেন, 'প্রার্থনা করি, এই খবর যেন সত্যি হয়৷'
যে আবাউদ ২০১০ সালে ছিঁচকে চুরির জন্য জেলে গিয়েছিল, ছাড়া পেয়ে ২০১৪ সালে সে-ই পাড়ি জমাল সিরিয়ায়৷ কস্মিনকালেও যার ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না, হঠাত্ সে হয়ে গেল জিহাদি৷ এতটাই, যে ১৩ বছর বয়সি ছোট ভাই ইউনিসকেও সে সিরিয়ায় আসতে প্ররোচিত করে৷ এর পরই আবাউদের বাবা ওমর তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেন৷
সেই সময় ওমর সাংবাদিকদের বলেন, 'আমি আর পারছি না৷ আমি অসুস্থ৷ ওই ছেলে আমাদের মান, সম্মান, সব ডুবিয়েছে৷ কোনওদিন আর ওর মুখদর্শন করব না৷' এক সময়, ওমর ব্রাসেলসের মোলেনবিক এলাকায় একটি কাপড়ের দোকান চালাতেন৷ সপরিবার থাকতেন ফিউচার স্ট্রিটে৷ আবাউদের কার্যকলাপে তিতিবিরক্ত হয়ে বেলজিয়াম ছেড়ে এখন তাঁরা মরক্কোর বাসিন্দা৷ ফিউচার স্ট্রিটের বাড়িটিরও বিক্রিবাটার কথা চলছে৷
আন্তর্জাতিক দুনিয়া এখন আবাউদকে কুখ্যাত জিহাদি বলে আখ্যা দিয়েছে৷ সেই আবাউদকে ধরতে বুধবার ফ্রান্সের পুলিশ হানা দিয়েছিল প্যারিসের শহরতলি স্যাঁ দেনির একটি বাড়িতে৷ পুলিশ-গোয়েন্দা-সেনা, সব বিভাগের চোখে ধুলো দিয়ে যে বেলজিয়াম-ফ্রান্স-সিরিয়া ঘুরে বেড়িয়েছে, এ বার বোধহয় তার দিন ঘনিয়ে এল৷ সোমবারই পুলিশের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, আবাউদই গত শুক্রবারের প্যারিস নাশকতার মূল চক্রী৷ সেই ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ১২৯ জনের৷ আবাউদ সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়াই ছিল পুলিশের৷ কিন্ত্ত কখনও নাগালের মধ্যে আসেনি সে৷
আবাউদের জন্ম মরক্কোতে৷ পরে তারা বেলজিয়ামে চলে আসে৷ ব্রাসেলসের বহুজাতি ভিত্তিক মলেনবিক-সাঁ-জাঁ এলাকায় বড় হয়েছে সে৷ ইতিমধ্যেই ফ্রান্সে দু'টি নাশকতার ঘটনার সঙ্গে সম্ভাব্য চক্রী হিসেবে নাম জড়িয়ে গিয়েছিল তার৷ দু'টি ছকই অবশ্য ব্যর্থ হয়৷ প্যারিসগামী দ্রুতগতির একটি ট্রেন ও প্যারিসের শহরতলির একটি চার্চ ওই নাশকতার লক্ষ্যে ছিল৷ বেলজিয়াম পুলিশেরও সন্দেহের তালিকায় শীর্ষেই ছিল আবাউদের নাম৷ সে দেশের ভেরভিয়েরে একটি জঙ্গি শাখাকে সংগঠিত করা ও আর্থিক সাহায্য দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে৷ পুলিশি অভিযানে ধ্বংস হয় ওই শাখা৷ মারা যায় দুই জঙ্গি, যাদের আবাউদের সঙ্গী বলেই মনে করা হয়েছিল৷ তাও তার টিকিও ছুঁতে পারেনি পুলিশ৷ সে যেন অশরীরী৷
ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর ইংরেজি ভাষার পত্রিকা দাবিক-এ জানানো হয়েছিল, জঙ্গি কার্যকলাপ গড়ে তুলতে গোপনে বেলজিয়াম ফিরে এসেছে আবাউদ৷ সিরিয়া থেকে ফেরার সময়েই আবাউদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় আইএস নেতা আবু মহম্মদ অল-আদনানির৷ তার বিধর্মীদের খতম করার ডাক মনে ধরে আবাউদের৷ অল-আদনানির রেকর্ডেড বার্তায় 'বিধর্মী'দের তালিকায় ফরাসিদের বলা হয়েছিল 'ঘৃণ্য ও হিংসুটে' ৷
কিন্ত্ত বেলজিয়ামে ছবি-সহ তার নামে হুলিয়া জারি হতেই ফের আবাউদ পালিয়ে যায় সিরিয়ায়৷ মজা করে একবার সে বলেছিল, 'এক পুলিশ অফিসার আমাকে আটকেছিল৷ আমার মুখের সঙ্গে ছবির মিল খুঁজছিল বোধহয়৷ কিন্ত্ত তারপর ছেড়ে দেয়৷ হয়তো কোনও সাদৃশ্য খুঁজে পায়নি!'
ফ্রান্সের এক সাংবাদিক একবার তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে আবাউদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন৷ এতিয়েঁ উবার নামে ওই সাংবাদিক সোমবার জানিয়েছেন, 'আমার এক দিকে ছিল বিস্ময়৷ অন্য দিকে আমি দেখেছিলাম, কিছু ঘটতে চলেছে৷ আপনি তাকে নির্দেশ দিতে দেখতে পারেন৷ যে কোনও চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য তৈরি থাকায় তাকে একজন নেতা বলেও মনে হতে পারে৷' -সংবাদসংস্থা
প্যারিস: হাসিখুশি গোলগাল চেহারার ছোট্ট ছেলেটি৷ গভীর দু'টো চোখ৷ যেন সাক্ষাত্ দেবশিশু৷ ব্রাসেলসের সব থেকে নামজাদা স্কুল স্যাঁ পিয়ের দুকল্-এর ছাত্র৷ কে জানত, তার মৃত্যুর গুজবে স্বস্তি পাবে তারই বাড়ির লোক৷