হাতিয়ার খোল -কর্তাল , মৃদঙ্গ৷ রণসজ্জা কপালে কাটা রসকলি আর মুখে কৃষ্ণের নাম৷ এই সম্বল করেই অস্তিত্বরক্ষার মরিয়া লড়াই হিসেবে ধর্মতলার রানি রাসমণি রোডে আমরণ অনশন শুরু করলেন কয়েক হাজার কীর্তনশিল্পী৷ গত কয়েক দশকের মধ্যে শহরতলি অঞ্চলে চোখে পড়ার মতো দ্রুততায় কমে গিয়েছে কীর্তন অনুষ্ঠানের সংখ্যা৷ গ্রাম বাংলায় এখনও কীর্তনের জনপ্রিয়তা প্রবল৷ কিন্ত্ত যাতায়াতের সমস্যা , অর্থনৈতিক দুর্গতি ইত্যাদি বেশ কিছু কারণে রীতিমতো চাপে পড়েছেন কীর্তনশিল্পীর দল৷ বেশ কয়েক দফা দাবি নিয়ে তাই নভেম্বরে রাজ্যের যুবকল্যাণ ও আবাসনমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখাও করেছিলেন তাঁরা৷ মন্ত্রীমশাই আশ্বাস দিয়েছিলেন কীর্তন সম্প্রদায়ের সমস্যাগুলি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাধান করার৷ কিন্ত্ত তার কিছুই নাকি হয়নি৷ মুখ্যমন্ত্রীর 'ডান হাতের ' বরাভয়ে কোনও কাজ না -হওয়ায় ফের তেড়েফুঁড়ে আন্দোলন শুরু করেছেন কীর্তন শিল্পীরা৷ এ বার আর অন্য কাউকে নয় , খোদ শাসকদলের 'মাথা 'কেই মঞ্চে চাইছেন সারা ভারত কীর্তন ও ভক্তিগীতি অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা৷ সারা ভারত কীর্তন ও ভক্তিগীতি শিল্পী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সিদ্ধার্থশেখর দাসনস্কর জানিয়েছেন , প্রতি জেলায় অন্তত একটি করে কীর্তন ইনস্টিটিউট তৈরি , বয়স্ক কীর্তনশিল্পীদের মাসিক ভাতা , বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়ার জন্য সরকারি গাড়ির সাহায্য , চিকিত্সা ও বিমার সুবিধা এবং গৃহহীন কীর্তনশিল্পীদের বাসস্থানের দাবি রয়েছে তাঁদের সংগঠনের৷
এই বিষয়ে মুখমন্ত্রী উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস না -দিলে রানি রাসমণি রোড থেকে কিছুতেই তাঁরা অবস্থান তুলবেন না৷ সংগঠনের অন্য এক সদস্য সুব্রত নস্কর জানিয়েছেন , বর্তমানে ভোটের বিষয়টি মাথায় রেখে 'কীর্তনশিল্পীদের ' সাহায্য করার নামে রাজনীতির নোংরা খেলা চলছে৷ যাঁরা নিজেদের কীর্তনশিল্পী বলে দাবি করছেন , তাঁদের অনেকেই তা নন৷ এই বিষয়ে সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে তবেই কাজ করা উচিত বলে মনে করছেন সুব্রতবাবু৷ একদিকে সংগঠনের নেতৃস্থানীয়রা এমন ভাবে সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলনের কথা ভাবছেন৷ অন্য দিকে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা কীর্তনশিল্পীদের অনেকেই কীর্তনের ভবিষ্যত্ নিয়ে রীতিমতো শঙ্কাপ্রকাশ করেছেন৷ গোসাবা থেকে অবস্থান বিক্ষোভে যোগ দিতে আসা নিবারণ দাস জানিয়েছেন , আগে সন্তাহে গড়ে চারটি করে কীর্তনের অনুষ্ঠান ছিল স্বাভাবিক ঘটনা৷ কিন্ত্ত এখন সন্তাহে গড়ে একটি কীর্তনের বায়না পেলেই নিজেদের ধন্য বলে মনে করছেন শিল্পীরা৷ একই কথা শোনালেন মৃদঙ্গবাদক কৃষ্ণকমল নস্কর৷ দিনের বেলা কৃষ্ণকমলবাবু রাণাঘাটে সব্জি বিক্রি করেন৷
জানালেন , কয়েক বছর আগেও দিনে কাজ ও সন্ধে থেকে গানের অনুষ্ঠানে থাকার জন্য তাঁর 'অবসর ' বলে কিছুই ছিল না৷ কিন্ত্ত , এখন পরিস্থিতি আমূল বদলে গিয়েছে৷ কীর্তনের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের একাংশ মনে করছেন , মানুষের মধ্যে সামাজিকতা বোধ ক্রমশ কমছে৷ তাই , মানুষকে কীর্তন আর সে ভাবে টানে না৷ কেউ কেউ আবার বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে তৈরি সিরিয়ালগুলির কথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন , চ্যানেল ঘোরালেই যখন এই সব দেখা যাচ্ছে তখন শীতের রাতে চাদর মুড়ি দিয়ে মাটিতে বসে কৃষ্ণের নাম শোনার কষ্ট কেন করবেন সাধারণ মানুষ ? এ ছাড়া কীর্তনকে জনপ্রিয় করার কোনও চেষ্টাই করা হয়নি এতদিন৷ এই কারণেই কমছে কীর্তনের জনপ্রিয়তা৷ অনুষ্ঠান -পিছু পাওয়া অর্থের পরিমাণও গত কয়েক বছরে তেমন বাড়েনি৷ নেই কোনও সুবিধাও৷ তাই বহু ক্ষেত্রেই কীর্তন থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করেছেন বংশানুক্রমিক ভাবে কীর্তনের চর্চা করে আসা পরিবারের বহু সদস্যই৷ এই কারণেই ধর্মতলার অবস্থান বিক্ষোভের দিকে অনেকটা আশা নিয়ে তাকিয়ে আছেন বাংলার কীর্তনশিল্পের সঙ্গে জড়িত পরিবারগুলির সদস্যেরা৷ কয়েক শতাব্দী ধরে বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে যাওয়া এই ভক্তিগীতির অস্তিত্ব রাখতেই অহিংস পথে আন্দোলন কীর্তনশিল্পী সংগঠনের৷
Kubalay.Banerjee@timesgroup.com