গত ১৬ ডিসেম্বর মহা সমারোহে উদ্বোধন হয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুত্ উন্নয়ন নিগম (পিডিসিএল )-এর সাগরদিঘি কেন্দ্রের প্রথম ৫০০ মেগাওয়াট উত্পাদন ক্ষমতার ইউনিটটি৷ কিন্ত্ত , তা নিয়ে সংবাদমাধ্যম ও শিল্পমহলের তেমন কোনও হেলদোল হল না৷ যেন নেহাতই , উপেক্ষার মধ্যেই ইউনিটটির উদ্বোধন হল৷ কিন্ত্ত , কেন ? অতীতে রাজ্যে নতুন বিদ্যুত্ উত্পাদন ইউনিট মানেই একেবারে হইহই কাণ্ড শুরু হয়ে যেত৷ অবস্থাটা বদলে গেল কেন ? কারণটা খুবই সহজ৷ আগে নতুন বিদ্যুত্ কেন্দ্র আসা মানেই লোডশেডিং -এর হাত থেকে কিছুটা মুক্তি৷ কিন্ত্ত , রাজ্যে বিদ্যুত্ উদ্বৃত্ত হতে শুরু করেছে অনেক বছর ধরেই৷ কাজেই আর একটি ইউনিট এল কি এল না , তা নিয়ে কে -ই বা মাথা ঘামায় !কিন্ত্ত , তা বলে এই নয় যে নতুন করে বিদ্যুত্ ঘাটতি দেখা না গেলে নতুন বিদ্যুত্ কেন্দ্র বসানোর কথা ভাবা হবে না৷ যেমন , সাগরদিঘিতে আগের দুটি ৩০০ মেগাওয়াটের ইউনিট থাকার পরেও দুটি ৫০০ মেগাওয়াটের ইউনিট বসানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল অন্তত আট বছর আগে৷ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল ২০১১ -র ২৩ ফেব্রুয়ারি৷ মানে আগের বাম সরকারের আমলে এবং গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে৷ তার আগের দিনই ইউনিট দুটিতে যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও বসানোর দায়িত্ব দিয়ে চুক্তি করা হয়েছিল কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যালস লিমিটেড (ভেল )-এর সঙ্গে৷
লক্ষ্যমাত্রা ছিল , ৪৮ মাসের মধ্যে প্রথমটি এবং তার মাস চারেক পর দ্বিতীয় ইউনিটটি তৈরি হয়ে যাবে৷ কিন্ত্ত , বাস্তবে সেই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী , ২০১৫ -র ফেব্রুয়ারিতে ইউনিটটি তৈরি করার কাজ শেষ হয়নি৷ শেষ পর্যন্ত ডিসেম্বরে একটি ইউনিটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলেও , ইউনিটটি থেকে নিয়মিত বিদ্যুত্ উত্পাদন শুরু হতে ঢের দেরি৷ তা সত্ত্বেও কেন এত তাড়াহুড়ো করে ইউনিটটির উদ্বোধন করা হল ? ওয়াকিবহাল মহলের মতে , এটা কেবলমাত্র আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে সরকারের সাফল্যের মুকুটে আরও একটি পালক গোঁজার জন্য৷ এই তাড়াহুড়োর অন্য কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া ভার৷ আর ২০১১ সালে দুটি ইউনিটের শিলান্যাস করেও তো ভোটে শোচনীয় ভাবে হেরে গিয়ে ক্ষমতাচ্যত হয়েছিল আগের বামফ্রন্ট সরকার ! এখনকার তৃণমূল সরকার অবশ্য ভোটের ফলাফল নিয়ে তেমন উদ্বিগ্ন নয়৷ তবু নির্বাচনী প্রচারে তো এই উদ্বোধন বিলক্ষণ কাজে আসবে !কিন্ত্ত , প্রচার করতে গিয়ে যে সময়টা বেছে নেওয়া হল , সেটা ভুল৷ কেননা , ইউনিটটিতে এখনও মূল যন্ত্রপাতি বসানোর কাজ শেষ হয়নি৷ আনুষাঙ্গিক পরিকাঠামো নির্মাণও অসম্পূর্ণ৷ সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্তারাই স্বীকার করছেন , ২০১৭ -র মার্চের আগে পুরোদস্ত্তর উত্পাদন সম্ভব নয়৷ ইউনিটের বয়লারে কয়লা পাঠাতে হয় একেবারে পাউডারের মতো গুঁড়ো করে৷ এজন্য ৯টি কোল মিল থাকতে হয়৷ সেখানে এখনও পর্যন্ত তৈরি হয়েছে মাত্র ৫টি কোল মিল৷ বয়লারে কয়লা পাঠানোর জন্য দরকার কোল হ্যান্ডলিং প্ল্যান্ট ও রেল ব্যবস্থার মাধ্যমে কয়লা আনার পরিকাঠামো৷ আর তা তৈরি হতে দেরি আছে৷ যা জানা যাচ্ছে , কোল হ্যান্ডলিং প্ল্যান্ট পুরোপুরি তৈরি হতে ২০১৬ -র অক্টোবর হয়ে যাবে৷ আর বয়লারে যে কয়লার ছাই তৈরি হয় , তা সরানোর জন্য প্রয়োজন অ্যাশ হ্যান্ডলিং প্ল্যান্ট৷ তারও কাজ ভাল করে শুরু হয়নি৷ এই প্ল্যান্ট সম্পূর্ণ তৈরি হতে অন্তত ২০১৭ -র মার্চ৷
বয়লারে পরিশোধিত জল গরম করে বাষ্প তৈরি করতে হয়৷ সেই জল পরিশোধন করার প্ল্যান্ট তৈরির কাজও শেষ হয়নি৷ জল নিয়ে আসার জন্য গঙ্গার ধারে যে ইনটেক পাম্প হাউস তৈরি হওয়ার কথা , তার কাজ শুরুই করা যায়নি স্থানীয় নানা ঝামেলার কারণে৷ আর সেই জল এনে যে চৌবাচ্চায় রাখার কথা তার নির্মাণ কাজও থমকে গিয়েছে জমি সংক্রান্ত গোলমালে৷ ২০১৬ -র সেপ্টেম্বরের আগে এ সব তৈরি হওয়া সম্ভব নয় বলেই সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের একাংশ মনে করছেন৷ সেন্ট্রাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটি -র নিয়ম হল , পরীক্ষামূলক বিদ্যুত্ উত্পাদন (সিনক্রোনাইজ ) শুরুর ৯০ দিনের মধ্যে বাণিজ্যিক উত্পাদন শুরু করতে হয়৷ তা যদি করে না ওঠা যায় , সাগরদিঘির নতুন ইউনিটের বিদ্যুত্ গ্রিডে পাঠিয়েও ন্যায্য দাম মিলবে না৷ এটাও নিয়ম , নতুন ইউনিট একবার সিনক্রোনাইজ করে দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে ইউনিট থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুত্ উত্পাদনযোগ্য বলে ধরে নিতে হবে৷ উত্পাদিত বিদ্যুত্ বিক্রির ক্ষেত্রে মাসুল নির্ধারিত হবে তারই ভিত্তিতে৷ অথচ , এখানে নির্মাণের অনেক কাজ বাকি থাকা সত্ত্বেও তড়িঘড়ি সিনক্রোনাইজ করে দেওয়ায় বিপদ বাড়বে নিগমের৷ কারণ , মাসুল হিসাব করা হবে ইউনিটটি বিদ্যুত্ উত্পাদনযোগ্য এটাই ধরে নিয়ে৷
আর এতে বিলক্ষণ লোকসান করবে নিগম৷ আরও বড় প্রশ্ন, কে কিনবে বিদ্যুত্? এত দিন নিগমের উত্পাদিত বিদ্যুত্ কিনে নিত রাজ্য বিদ্যুত্ বণ্টন সংস্থা৷ তারা কিন্ত্ত সাগরদিঘির বিদ্যুতের উপর মোটেই ভরসা রাখছে না৷ আগামী গ্রীষ্মে চাহিদা মেটাতে তারা নিগমের উপর সম্পূর্ণ ভরসা না রেখে রাজ্যের বাইরে থেকে বিদ্যুত্ আমদানি করবে৷ সাগরদিঘির ইউনিট থেকে বিদ্যুত্ এখনই মিলবে না বুঝেই বণ্টন সংস্থা নিলাম ডেকে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বিদ্যুত্ কিনবে৷ মোটামুটি ৫০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুত্ কেনার দরকার পড়বে সম্পূর্ণ চাহিদা মেটাতে৷ বণ্টন সংস্থার চেয়ারম্যান নারায়ণস্বরূপ নিগম বলেছেন , বিদ্যুত্ কেনা হবে ইউনিট প্রতি ২ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ২ টাকা ৯০ পয়সার মধ্যে৷ এই দাম নিগমের বিদ্যুতের থেকে অনেক সস্তা৷ এর ফলে , বণ্টন সংস্থা প্রায় ৯০ কোটি টাকা বাঁচাতে পারবে৷ সাগরদিঘিতে পরে বসবে আরও একটি ৫০০ মেগাওয়াটের ইউনিট৷ তারও শিলান্যাস হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর৷ তা হলে সাগরদিঘির বিদ্যুত্ বিক্রির জন্য নিগমকে আলাদা বাজার খুঁজতে হবে৷ সাধারণত , দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি ছাড়া বাজারে বিদ্যুত্ বিক্রি করে ভাল দাম পাওয়া কঠিন৷
এখন না হয় রাজ্যে বিদ্যুত্ ঘাটতি কম৷ পরে আরও বিদ্যুত্ দরকার পড়লে সাগরদিঘির বিদ্যুত্ কিন্ত্ত বণ্টন সংস্থা পাবে না , যত দিন না অন্য ক্রেতার সঙ্গে নিগমের চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে৷ সাত বছর আগে সাগরদিঘির ইউনিটগুলির পরিকল্পনা করা হয়েছিল এটা ভেবে যে ভবিষ্যতে রাজ্যে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে৷ কিন্ত্ত , বাস্তবে তা হয়নি৷ আর নতুন নতুন শিল্প না এলে চাহিদাই বা তেমন বাড়বে কেমন করে ? তা হলে কি সাত বছর আগে যে অনুমান করা হয়েছিল , তা সেই সময়ে ভুল ছিল৷ একেবারেই না৷ কারণ , আনুমানিক অঙ্ক কখনও মিলবে , কখনও মিলবে না৷ সেই বামপন্থীদের যুক্তফ্রন্ট সরকার ৬০ -এর দশকের শেষ দিকে হিসাব করতে ভুল করেছিল বলেই রাজ্য বিদ্যুত্ ঘাটতির মাসুল চোকাল গোটা ৭০ , ৮০ এবং কিছুটা ৯০ -এর দশক ধরে৷ সেই শিক্ষা নিয়েই আর অন্তত পরিকল্পনা করতে ভুল হয়নি৷ কিন্ত্ত , সমস্যা সাগরদিঘির বিদ্যুত্ যাবেটা কোথায় ? সাগরদিঘির বিদ্যুত্ অন্য রাজ্যে রন্তানি করার চেষ্টা চালাতে হবে৷ তবে দাম বেশি হলে এই বিদ্যুত্ বাজার পাবে না৷ ফলে , ঝুঁকি থেকেই যাবে৷
গৌতম গুপ্ত