তিনিই বরকর্তা৷ তাই ব্যস্ততার শেষ নেই৷ অতিথি-অভ্যাগতদের খাতির-যত্নে যাতে কোনও ত্রুটি না থাকে, সে দিকে নজর রাখতে হচ্ছে৷ আবার পোশাকও হতে হবে মানানসই৷ সে দিকেও তিনি ছিলেন নিখুঁত৷ পরনে পাঠানি সালোয়ার-কুর্তা, হাতকাটা জ্যাকেট৷ মাথায় গোলাপি রঙের কোঁচানো পাগড়ি৷ তার বাঁধন, প্লিট- সবই রাজকীয়৷এই সেই পাগড়ি, যা দিন দুয়েক আগে হয়ে উঠেছিল ভারতের দৌত্যের প্রতীক! কারণ, এই পাগড়ি পরেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, তাঁর নাতনি মেহর-উন-নিসার বিয়েতে৷ তার থেকেও বড় কথা, ততক্ষণে দু'দেশের সংবাদমাধ্যমেই চাউর হয়ে গেছে যে ওই পাগড়ি সে দিনই ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁর আচমকা সফরে লাহোর গিয়ে শরিফকে উপহার দিয়েছেন৷ আর সেটার গুরুত্ব তাঁর কাছে এতটাই যে, তিনি তা পরেই নাতনির বিয়েতে মেতেছিলেন৷ আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছে নানা আলোচনা৷ আম, শাল, শাড়ির পরে তা হলে কি কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজার্সের পরের ধাপ এ বার গোলাপি পাগড়ি? অন্য দিকে গুঞ্জন, মোদী তো সে দিন সকালেই ফোনে নেমন্তন্ন পেয়েছেন বিয়ের, তা হলে তিনি এমন পাগড়ি উপহার দিলেন কী করে! এত তাড়াতাড়ি তা কাবুলে পৌঁছলই বা কী করে? তা হলে কী যতটা 'আচমকা ও গোপন' এই লাহোর যাত্রা বলা হচ্ছে, ততটা নয়? প্রশ্ন তো উঁকি মারছে কিন্ত্ত উত্তর যে নেই৷
তাতে কী! 'দাদু' শরিফের মাথায় মোদীর উপহার - এর থেকে বড় আর কী-ই বা হতে পারে! শরিফের দলের এক নেতা তো বলেই ফেললেন, 'এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, শরিফ দু'দেশের সম্পর্ককে কতটা গুরুত্ব দেন৷ কত আন্তরিক তিনি৷' কিন্ত্ত তাল কাটল কয়েকয়া টুইটে৷ না, ভারত-পাক সম্পর্কে দুই প্রধানের মনোভাব নিয়ে নয়, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠা পাগড়ি নিয়ে৷ পাকিস্তানের সাংবাদিক বেনজির সোমবার সেখানে জানান, এই পাগড়ির সঙ্গে মোদীর কোনও সম্পর্ক নেই৷ এটা শরিফ পরিবারের ঐতিহ্য৷ কারণ ওই পরিবারের অনেক পুরুষ সদস্যের মাথাতেই একই কায়দায় একই পাগড়ি শোভা পাচ্ছে৷ তারই কিছু পরে শরিফের দলেরই এক সদস্য মন্তব্য করেন, 'মিডিয়া এগুলো কী লিখেছে! এটা মোদীর উপহার এমন কথা কে বলল! এটা তো পারিবারিক রীতি৷' এই একই কথা জানান শরিফ-কন্যা মারিয়ামও৷তা হলে কি এই উপহার নেহাত্ই 'নিষ্ফল?' সেই সন্দেহই সত্যি হল৷ মঙ্গলবার সন্ধেয় ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ বললেন, 'না, সে দিন কোনও উপহার কারও জন্যই নিয়ে যাওয়া হয়নি৷ প্রধানমন্ত্রী কাউকে কোনও উপহার দেননি৷' কিন্ত্ত যা নিয়ে এত চর্চা, এত কথা তার কোনও ভিত্তিই নেই?এর উত্তর মিলল বিদেশ মন্ত্রকেরই আর এক কর্মীর কাছে৷ বললেন, 'দু'দেশের মধ্যে সংস্কতিগত অনেক মিল আছে৷ তেমনই পোশাক-পরিচ্ছদ, খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রেও তা দেখতে পাওয়া যায়৷
যেমন গজল, বিরিয়ানি, সালোয়ার কামিজ, বলিউড ইত্যাদি৷ সে দিন শরিফজি যে স্টাইলে পাগড়ি পরেছিলেন, তার সঙ্গে কি আমাদের দেশের কোনও অমিল আছে? ওই রকমই কুঁচি রেখে গোলাপি রঙের পাগড়িতে স্বাগত জানায় মেয়ের বাড়ির লোকেরা৷ বেশি দেখা যায় রাজস্থান ও পাঞ্জাবে৷ আর সে দিনই মোদীজি গেছেন, তাতেই হয়তো চাউড় হয়ে যায় যে ওই পাগড়ি মোদীজির থেকে পেয়েছেন শরিফজি!' নাকি এও এক ধরণের 'উদ্ভাবনী কূটনীতির' উদাহরণ? জবাবে এল পাল্টা প্রশ্নই৷ 'কেন, হলেই বা মন্দ কী! পাগড়ি সামলানো নিয়ে কত্ত রক্ত বয়ে গেছে এর আগে... এ বার না হয় উল্টোটাই হল!' কিন্ত্ত তা হলে তো বিদেশমন্ত্রক...? 'আরে, ব্যাপারটা তো বেশ ইতিবাচকই হয়েছে৷ এ ভাবেও যদি একটা হূদ্যতা তৈরি হয়, তা হলে তো তা ভবিষ্যতে দুই দেশকে আরও কাছে এগিয়ে দেবে৷' কথাটার হয়তো ভিত্তি রয়েছে৷ এর আগে সীমান্ত পারে তুমুল সন্ত্রাসের সময়ও শরিফ ঈদ উপলক্ষে মোদীকে আম পাঠিয়েছিলেন৷ দু'দেশ সাক্ষী থেকেছে 'মাদার ডিপ্লোম্যাসির'ও, - যখন মোদী শরিফের মাকে শাল ও শরিফ মোদীর মাকে শাড়ি পাঠিয়েছিলেন৷ তা নাকি দুই অশীতিপরকেই মুগ্ধ করেছিল, দৃঢ় করেছিল 'জলবায়ু পরিবর্তনের' ইঙ্গিতকে৷তাই, পাগড়ি কি সত্যিই 'মাদার অফ অল ডিপ্লোম্যাসি' হয়ে রইল? এর উত্তর মৃদু হাসি ছাড়া আক কী-ই বা হতে পারে!
অন্বেষা বন্দ্যোপাধ্যায়