প্রশ্ন হল, কী কারণে বাজপেয়ীর নীতিকেই সব থেকে ফলদায়ক বলে মনে করছেন কূটনৈতিক মহল ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা? সংক্ষিন্ততম উত্তর-বাজপেয়ী ১৯৯৮ সালে পোখরানে দ্বিতীয় পরমাণু বিস্ফোরণের পর যে পাক নীতি ও আন্তর্জাতিক নীতি গ্রহণ করেছিলেন, তা ছিল ভিন্নধর্মী৷ একদিকে নরম, অন্যদিকে গরম এ ভাবেই তিনি এগিয়েছিলেন৷ শুধু তাই নয়, পাকিস্তান নীতি তিনি সম্পূর্ণ নিজের হাতে রেখেছিলেন, এবং সেই দেশের সঙ্গে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সম্পর্ক নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য উচ্চতায়৷ সেখানেই গুরুত্ব পেয়েছিল 'সংযমী কৌশল' নীতি৷ তার অন্যতম কারণ, সীমান্তপারের সন্ত্রাস কোনও দিনই বন্ধ করেনি পাকিস্তান, তা সত্ত্বেও বাজপেয়ী বৈঠক বাতিল বা বাস বন্ধ, এমন পথে হাঁটেননি৷ বরং যখন এই জঙ্গি সন্ত্রাস চলেছে, এমনকি কার্গিল সংঘর্ষ তীব্র হয়ে উঠেছে তখনও তিনি তত্কালীন পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফের সঙ্গে কূটনৈতিক স্তরে আলোচনা চালিয়ে নিয়ে গেছেন৷ বন্ধ করেননি নয়াদিল্লি-লাহোর বাস যাত্রা৷ আগ্রা শীর্ষ বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পরেও তিনি সম্পর্ক ফের জোড়া লাগবে, তা নিয়ে আশাবাদী ছিলেন৷ দু'দেশের মধ্যে যে অবিশ্বাসের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা দূর করতে নেওয়া হয়েছিল দু'দেশের মধ্যে কনফিডেন্ট বিল্ডিং মেজার্স৷ নিয়মিত হল আলোচনাও৷
এই নীতিই পরবর্তী কালে কম-বেশি ইউপিএ সরকার বজায় রেখেছিল৷কিন্ত্ত প্রশ্ন হল, মোদী পাকিস্তানের ক্ষেত্রে যে নীতি নিচ্ছেন, তা কি পুরোটাই বাজপেয়ীর পথে? কূটনৈতিক মহল বলছে, কিছুটা ব্যতিক্রম তো আছেই৷ যেমন এই 'উদ্ভাবনী কূটনীতি, অর্থাত্ সুযোগ পেলেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই সাক্ষাত্ করা৷' এ রকম কাজ বাজপেয়ী কখনও করেননি, বা মোদীর ভারত যে ভাবে দু'টি ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা বাতিল করেছে, সীমান্তপারের সন্ত্রাস নিয়ে বাগ্যুদ্ধ চালিয়েছে - তার কোনওটাই বাজপেয়ীর নীতিতে ছিল না৷ তা ছাড়া তিনি প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার জন্য কোনও তাড়াহুড়ো করেননি, কিন্ত্ত মোদীর মধ্যে সে লক্ষণ আছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা৷ কিন্ত্ত এ সব কথাকে গুরুত্ব দিতে মোটেই রাজি নয় বিজেপি৷ বিরোধীরা যখন মোদী-শরিফ বৈঠকে সজ্জন জিন্দলের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তখন বিজেপি বলছে, 'এটা আসলে প্রকৃত অর্থেই জলবায়ু পরিবর্তন৷ এমনকি দুই প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সমীকরণ বুঝিয়ে দিয়েছে তা এই কূটনীতির সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যের৷' বিজেপির মুখপাত্র এম জে আকবর বলেছেন, 'তিনি আসলে পরিবর্তনের মুহূর্তের কান্ডারি, তা আমরা ২০১৪ সালের সার্ক বৈঠকেও দেখেছি৷' আর এর থেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব বলেছেন, 'এক দিন ফের ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ মিলে যাবে৷ তৈরি হবে অখণ্ড ভারত৷ শক্তিপ্রয়োগ করে নয়, জনমতের ভিত্তিতেই তা হবে৷' এমন মন্তব্য ফের বিতর্কের বীজ বুনতে পারে৷
তবে এ বার আর শুধু ভারত নয়, উদ্যোগ নিয়েছে পাকিস্তানও৷ রয়টার্সের দাবি, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফ ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নাসির খান জানজুয়া রয়েছেন এই শান্তি প্রক্রিয়ার পিছনে৷ শরিফ মন্ত্রিসভার এক সদস্য জানান, 'এ বারের বৈঠকটা একেবারেই অন্য রকম, কারণ আমাদের দেশে যাদের ভূমিকা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ, সেই সেনার সর্বোচ্চ স্তরের অনুমোদন ছিল এই বৈঠকে৷' তাই মনে করা হচ্ছে, জুনেজা দায়িত্ব নেওয়ার পর পাকিস্তানেরও আত্মবিশ্বাস অনেকখানি বেড়েছে৷ কারণ নাসির প্রাক্তন সেনাকর্তা৷ তিনি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক সম্পর্কে অত্যন্ত অভিজ্ঞ৷ আর সে জন্যই এই 'সত্যিকারের পরিবর্তন' সম্ভব হয়েছে৷ কূটনীতিবিদদের অনেকেই মনে করছেন, ভারতের সঙ্গে কথার ফলে সেনার হাতই শক্ত হচ্ছে পাকিস্তানে৷ কিন্ত্ত রাহিল-নাসির প্রমাণ করতে চাইছেন, সেনা নয়, তাঁরা অসামরিক সরকারের হাতই শক্ত করতে চাইছেন৷সীমান্তপারের এই বন্ধুতা কত দিন সংযমের কৌশল বজায় রাখতে পারে, সে দিকে তাকিয়ে সকলেই৷
এই সময়: সদা-এ-সরহদ বা সীমান্তের ডাক৷ সে ডাকে সাড়া দিয়েই ১৯৯৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি দিল্লি থেকে বাসের চাকা গড়িয়েছিল, তাতে চেপে বসেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী-দেশের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী৷ ওয়াঘায় গিয়ে তা যখন থামে, তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ৷ তৈরি হয়েছিল বন্ধুত্বের এক নতুন ভিত্তি৷ মৈত্রীর সে বাসের চাকা কার্গিল সংঘর্ষের সময়ও থামেনি কোনও দিন৷ সে জন্যই হয়তো বাজপেয়ীর পাক নীতির নাম 'সংযমী কৌশল'৷ আর এই নীতিই বজায় রাখুন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও, সেটাই চান লালকৃষ্ণ আদবানি৷মোদীর এই 'উদ্ভাবনী কূটনীতি' নিয়ে মার্গদর্শক মণ্ডলীর সদস্য আদবানিকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, 'বাজপেয়ীজি যে নীতি নিয়েছিলেন সেটাই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন৷ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটিয়ে মোদীজি ও তাঁর মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যরা সন্ত্রাসবাদের অবসান ঘটান৷ এই একটা বিষয় দু'দেশের ক্ষেত্রেই বিরাট প্রসঙ্গ৷' কিন্ত্ত এর বাইরে তিনি মোদীর এই 'গোপন ও আচমকা' কূটনীতি সম্পর্কে আর কিছুই বলেননি৷ অর্থাত্ এর থেকে বলা যেতে পারে, আদবানি সন্ত্তষ্ট বা অসন্ত্তষ্ট কোনওটাই নন৷ এর আগে বেশ কয়েকবার আদবানির নেতৃত্বে মার্গদর্শক মণ্ডলী মোদী নেতৃত্বকে তুলোধোনা করেছে, অতি সম্প্রতি কীর্তি আজাদের সাসপেন্ড হওয়া নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেছেন, কিন্ত্ত পাকিস্তান সফর সম্পর্কে আদবানির কাছ থেকে কোনও নেতিবাচক কথা শোনা যায়নি৷