সিপিএমের সঙ্গে বোঝাপড়ার প্রশ্নে জল্পনা জিইয়ে রেখেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও৷ এ রাজ্যে কংগ্রেস কি সিপিএমের হাত ধরতে প্রস্ত্তত? একদা কট্টর সিপিএম বিরোধী অধীরবাবু বলেন, 'এই ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সনিয়া ও রাহুল গান্ধী নেবেন৷' তবে এ দিনই বর্ধমানে এক সভায় দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা অধীরবাবুর সামনেই দাবি তোলেন, কোনও অবস্থাতেই তৃণমূলের হাত ধরা চলবে না৷ তৃণমূলের সঙ্গে বোঝাপড়া হলে তাঁরা সিপিএমে যোগ দেবেন বলেও হুঁশিয়ারি দেন ওই নেতা-কর্মীরা৷ জবাবে অধীরবাবু আশ্বাস দেন, তৃণমূলের হাত ধরবে না কংগ্রেস৷ সিপিএম তথা বামেদের সম্পর্কে জবাব উহ্য রাখেন তিনি৷ আর এক প্রবীণ কংগ্রেস নেতা তথা কট্টর অধীর বিরোধী হিসেবে পরিচিত আব্দুল মান্নান এ দিনও বলেন, 'আমি মনে করি, দোটানায় না-থেকে এখনই কংগ্রেসের উচিত বামপন্থীদের সঙ্গে নির্বাচনী বোঝাপড়া গড়ে তোলা৷ সিপিএমেরও এই পথেই চলা উচিত৷' দিন কয়েক আগে প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি সোমেন মিত্র রীতিমতো সাংবাদিক বৈঠক ডেকে সনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধীদের বার্তা দেন, তৃণমূলের হাত ধরলে এ রাজ্যে কংগ্রেসের সাইনবোর্ডটাও অবশিষ্ট থাকবে না৷ ঘটনাচক্রে, ওই দিনই দিল্লিতে গিয়ে ন্যাশনাল হেরাল্ড বিতর্কে সনিয়া ও রাহুলের পাশে দাঁড়ান মমতা৷
পরদিন সনিয়ার বাড়িতেও যান তৃণমূল নেত্রী৷ সেই সাক্ষাত্কে স্বাগত জানিয়ে প্রদেশ কংগ্রেসের আর এক প্রাক্তন সভাপতি মানস ভঁুইয়া পরোক্ষে তৃণমূলের হাত ধরার পক্ষে সওয়াল করেন৷ সীতারাম ইঙ্গিত দিয়েছেন, সনিয়া ও মমতার বৈঠক নতুন কোনও রাজনৈতিক সমীকরণের জন্ম দেয় কি না, সে দিকে তাদের সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে৷সনিয়া গান্ধীর পার্টির সঙ্গে বোঝাপড়া নিয়ে দলে বিতর্ক সত্ত্বেও ব্রিগেডের সভার কয়েক ঘণ্টা আগে এই রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা নিয়ে সম্ভাবনার দরজা কিন্ত্ত বন্ধ করে দেননি সীতারাম৷ বিজেপির 'সাম্প্রদায়িক' রাজনীতির মোকাবিলায় কংগ্রেসের সঙ্গে মাঠেঘাটে হাত মিলিয়ে চলতে যে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই, শনিবার আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে খোলাখুলি জানালেন সীতারাম৷ এমনকি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মোকাবিলায় কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলানোর ক্ষেত্রে ইউপিএ জমানার 'দুর্নীতি' যে বাধা হবে না, তা-ও নির্দিষ্ট ভাবে বললেন সিপিএম সাধারণ সম্পাদক৷
প্লেনাম উপলক্ষে কেরলের প্রথম সারির নেতারা ইতিমধ্যে কলকাতায় চলে এসেছেন৷ বিধানসভা ভোট যত এগিয়ে আসছে কেরলে ততই কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে সুর চড়াচ্ছে সিপিএম৷ এ রাজ্যেও তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্রমশ আন্দোলন তীব্র করছে তারা৷ কিন্ত্ত মাস চারেক পর দুই রাজ্যে সিপিএমের মূল প্রতিপক্ষ নিয়ে দলের মধ্যে মতবিরোধ তীব্র৷ পশ্চিমবঙ্গ সিপিএমের একাংশের চাপে ইয়েচুরি কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার রাস্তা খোলা রাখলেও কেরল সিপিএম এর প্রবল বিরোধী৷ ইতিমধ্যে বিজয়ন, বেবি-সহ একদল নেতা পার্টির অন্দরের এর বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন৷ শনিবার সন্ধ্যায় কলকাতায় মালয়ালি সমাজের এক অনুষ্ঠানে কেরলের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভিএস অচ্যুতানন্দন কংগ্রেস প্রশ্নে জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন৷বাকপটু ইয়েচুরি একবারের জন্যও কংগ্রেসের সঙ্গে সরাসরি নির্বাচনী সমঝোতার কথা উচ্চারণ করেননি৷ কিন্ত্ত কথার মারপ্যাঁচে বুঝিয়েছেন প্রয়োজনে কংগ্রেসের সঙ্গে পরোক্ষ নির্বাচনী সমঝোতা করতে তাঁর কোনও আপত্তি নেই৷ সিপিএমের রাজনৈতিক-কৌশলগত লাইনে রাজ্যওয়াড়ি পরিস্থিতি অনুসারে 'ফ্লেক্সিবল ট্যাকটিক্স' গ্রহণের যে দরজা খোলা আছে সেই রাস্তা দিয়েই প্রয়োজনে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার ইঙ্গিত দিয়েছেন ইয়েচুরি৷ গৌতম দেব, অশোক ভট্টাচার্য, কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ নেতারা নানা ঢঙে এই সমঝোতার পক্ষে সওয়াল করছেন৷ সূর্যকান্ত মিশ্র-সহ সিপিএম রাজ্য নেতৃত্ব ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন, প্লেনামের পর আগামী জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারিতে এই নির্বাচনী সমঝোতার বিষয়টি তাঁরা চূড়ান্ত করবেন৷
তা হলে বোঝাপড়ার প্রশ্নে ঝেড়ে কাশছে না কেন দল? সিপিএমের একাংশের যুক্তি, মমতা যেমন সব তাস এখনই দেখাচ্ছে না, তেমনই আলিমুদ্দিন স্ট্রিটও আগ বাড়িয়ে জোট নিয়ে অবস্থানে যেতে চাইছে না৷ পরিকল্পিত ভাবে ধোঁয়াশা বজায় রাখছেন সিপিএম নেতৃত্ব৷ উভয়পক্ষই জল মাপছে৷ নির্বাচনী সমঝোতা নিয়ে অবস্থান স্পষ্ট না-করলেও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মোকাবিলায় কংগ্রেসের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে যে কোনও আপত্তি নেই তা খোলাখুলি জানাচ্ছেন ইয়েচুরি৷ তিনি বলেন, 'সমস্ত দেশপ্রেমী, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক শক্তির একজোট হওয়া প্রয়োজন সাম্প্রদায়িকতার বিরদ্ধে লড়াই করার জন্য৷' স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, গত লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের দুর্নীতির নিয়ে প্রচার চালিয়ে ভোটে গিয়েছে বামেরা৷ বামেদের নির্বাচনী স্লোগানে কংগ্রেস ও বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার ডাক দেওয়া হয়েছিল৷ কিন্ত্ত এখন বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কংগ্রেসের আগের দুর্নীতিকে ইয়েচুরি ধর্তব্যের মধ্যে রাখতে চাইছেন না কেন? তাঁর কথায়, 'আগে কে কোথায় কী করেছে, সেটা এই লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যাঁরা লড়াই করতে চাইবে তাঁদের সঙ্গে এই লড়াইয়ে থাকতে রাজি৷'
এই সময়: তৃণমূলকে হঠাতে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্নে আজ ব্রিগেডের সমাবেশে সিপিএম শীর্ষ নেতৃত্ব কী বার্তা দেন তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে জল্পনা শুরু হয়েছে৷ দলের সাংগঠনিক প্লেনাম উপলক্ষে আয়োজিত আজকের সমাবেশই সম্ভবত ভোটের আগে সিপিএমের শেষ ব্রিগেড৷ 'তৃণমূল হঠাও, বাংলা বাঁচাও; বিজেপি হঠাও, দেশ বাঁচাও'-এই স্লোগানকে সামনে রেখে দলের সাংগঠনিক ও জনভিত্তির শক্তিপরীক্ষা দিতে চলেছে তারা৷ সিপিএমের দাবি, ব্রিগেডে আজ লাখ দশেক লোকের সমাগম হবে৷তৃণমূল ও বিজেপির মোকাবিলায় আসন্ন বিধানসভা ভোটে কোন পথে এগোবে দল, বিশেষ করে তৃণমূলের মোকাবিলায় কংগ্রেসের হাত ধরা হবে কি না, তা নিয়ে রাজ্য সিপিএমে নানা মত রয়েছে৷ শনিবার দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি আগের মতোই কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়ার বিষয়টি জিইয়ে রেখেছেন৷ অথচ শুক্রবার ঠিক উল্টো কথাই বলেছিলেন পলিটব্যুরোর বর্ষীয়ান সদস্য বিমান বসু৷ কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়ার প্রশ্নই ওঠে না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি৷ স্বভাবতই আজ, ব্রিগেডের সমাবেশে দলের সমর্থকদের সামনে বিধানসভা ভোটের রণকৌশল নিয়ে কী বার্তা দেবে সিপিএম তা নিয়ে জোর জল্পনা তৈরি হয়েছে দলের অন্দরেও৷ একদিনের ব্যবধানে বিমানবাবু ও সীতারামের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য তাতে নয়া মাত্রা যোগ করেছে৷ শনিবার ইয়েচুরি বলেন, 'আমাদের পার্টি কংগ্রেসের দলিলে বলা আছে যে, রাজ্যের পরিস্থিতি অনুসারে সংশ্লিষ্ট রাজ্য নেতৃত্ব চড়ান্ত রণকৌশল ঠিক করতে পারবেন৷ ফ্লেক্সিবল ট্যাকটিক্স নিতে পারবেন৷ প্রয়োজন শুধু কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনুমোদন৷ আগামী জানুয়ারিতে রাজ্য নেতৃত্ব এই রণকৌশল চূড়ান্ত করবে৷'