জেলা পুলিশ এ বার আমজনতার সুরক্ষায় মন দেবে৷সৈকতাবাসের বিখ্যাত রেস্তোরাঁ ফের খুলবে সকলের জন্য৷মেন রোড বরাবর আর বিধিনিষেধ থাকবে না পর্যটকদের গাড়িগুলোর জন্য৷মুখ্যমন্ত্রী কলকাতা পাড়ি দিতেই ছন্দে ফিরল বাঙালির 'ঘরের পাশে'র সৈকতনগরী৷ তড়িঘড়ি সাজগোজের ঘনঘটা, পর্যটকদের ক্রিসমাস সন্তাহ উদযাপনের দিকে তাকিয়ে৷ বড়দিন যে কড়া নাড়ছে দরজায়! বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের মতোই দিঘার রাস্তা থেকে হোটেল, মেরিন ড্রাইভ থেকে সমুদ্র সৈকত- সর্বত্রই আছড়ে পড়ছে পর্যটকদের ঢেউ৷ মুখ্যমন্ত্রীর সাধের 'বাংলার গোয়া'য় বর্ষশেষের বোধন হল বলে৷বছরের শেষ সন্তাহে (২৫ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারি) দৈনিক কমপক্ষে দু'লক্ষ পর্যটকের পা পড়বে এখানে, মনে করছে দিঘার ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে প্রশাসন, সকলেই৷ এমনিতেই আজ-কাল, বৃহস্পতি-শুক্রতে সরকারি ছুটি থাকায়, সন্তাহের মাঝেও প্রবল ভিড় দিঘায়৷ তা-ও বড়দিনের মেকওভারের মাঝে ছোট্ট একটা বিরতি পড়ে গিয়েছিল৷
গত দু'দিন, মুখ্যমন্ত্রীর আগমন ঘিরে বর্ষশেষের প্রস্ত্ততিতে একটু হলেও যেন ভাটা পড়েছিল সাগরপাড়ের এ জনপদে৷ পুলিশ-প্রশাসন থেকে শুরু করে দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদ (ডিএসডিএ), মায় বড় কয়েকটা হোটেল কর্তৃপক্ষও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন ভিভিআইপি-র আপ্যায়নে৷ সুরক্ষা আর নিরাপত্তার বজ্র আঁটুনি তো ষোলো আনা ছিলই৷ তাই পর্যটকদের থিকথিকে ভিড়ের মাঝেও দিন দুয়েকের জন্য যেন থমকেই গিয়েছিল দিঘার প্রশাসন৷ বুধবার দুপুর পৌনে একটায় হেলিকপ্টারে মুখ্যমন্ত্রী কলকাতা উড়ে যেতেই ছন্দে ফিরল তারা৷ ফের সকলে ব্যস্ত হয়ে মন দিতে শুরু করল অতিথিসেবায়৷ বিকেল গড়াতেই স্পষ্ট, এ বার বর্ষশেষের সন্তাহে পর্যটকদের জোয়ার ছাপিয়ে যাবে বিগত বছরগুলোকে৷হোটেল ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, সম্প্রতি ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে দিঘায়৷ কলকাতার মানুষ লোক মারফত অনেকেই জেনে গিয়েছেন সে কথা৷ ঘিঞ্জি ওল্ড দিঘার 'সি-ভিউ'ও এখন ঝাঁ-চকচকে হয়ে টক্কর দিচ্ছে নিউ দিঘা, উদয়পুরের সঙ্গে৷ আর মুখ্যমন্ত্রীর সফর ঘিরে সংবাদমাধ্যমে গত দু'দিন যে প্রচার পেয়েছে দিঘা, তা একেবারেই উপরি পাওনা৷ বুধবার বেলা গড়াতেই তাই যেন দিঘা উপচে পড়ছে পর্যটকের ভিড়ে৷ তারই প্রতিফলন সরকারি টুরিস্ট লজ লাগোয়া 'হোটেল দিঘা'র ম্যানেজার পার্থ ঘোষের কথায়, 'বড়দিনে হোটেল সাজানোর প্রচুর মালপত্র এসেছে কলকাতা থেকে৷ সেগুলো সাজাব নাকি গেস্ট সামলাব, বুঝে উঠতে পারছি না৷ একটা ঘরও খালি নেই৷'
ঘর খালি কোথাও-ই নেই! তাই পর্যটক টানার 'অফার'ও নেই৷ সি-হক থেকে ডলফিন, সি-উইং থেকে ল্যরিকা, কোথাও নেই কোনও অফার৷ অভিজাত 'পাম রিসর্ট'-এর মালিক সাধন দে বলছেন, 'প্রতি বছর নানা প্যাকেজ, অফার, বর্ষবরণের অনুষ্ঠান ইত্যাদি দিয়ে আকর্ষণ বাড়ানো হয়৷ কিন্ত্ত এ বার আগে থেকেই সব বুকড৷ আর অফার দিয়ে কী হবে!' তাঁর মূল্যায়ন, গত কয়েক মাসে দিঘাকে সরকারি উদ্যোগে যে ভাবে সাজানো হয়েছে, তাতে পর্যটকের ভিড় ক্রমেই বাড়ছে৷ দিঘা-শঙ্করপুর হোটেলিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক বিপ্রদাস চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, দিঘায় সমুদ্র ছাড়াও যে দেশের বৃহত্তম মেরিন অ্যাকোয়ারিয়াম আছে, কাজু উদ্যান আছে, সায়েন্স মিউজিয়াম আছে, তা নিয়ে আগে কেউ মাথা ঘামাত না৷ ইদানীং সেগুলোকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে পর্যটনের শ্রীবৃদ্ধির লক্ষ্যে৷ অমরাবতীর সৌন্দর্যায়ন আগেই হয়েছিল৷ সোমবার সেখানে রোপওয়ের উদ্বোধন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ এ দিন থেকে হেলিকপ্টার পরিষেবাও চালু হয়ে গেল আনুষ্ঠানিক ভাবে যা শনি-রবিতে নিয়মিত চলবে পরশু, ২৬ তারিখ থেকে৷ 'এ সবের জন্যই দিঘার টান বাড়ছে৷ ফি বছর বড়দিন থেকে নববর্ষ পর্যন্ত দৈনিক লাখ দেড়েক পর্যটকের ঢল নামে দিঘায়৷ এ বছর আশা করছি, ভিড়টা লাখ দুয়েক ছুয়ে ফেলবে,' মন্তব্য সৈকতাবাসের রেস্তোরাঁ মালিক বিপ্রদাসবাবুর৷
বাড়তি ভিড়ের দিকে তাকিয়েই তটস্থ প্রশাসন৷ পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়ার বক্তব্য, 'সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো সময়সাপেক্ষ৷ তা-ও যাতে কোনও অঘটন না-হয়, তার জন্য আমরা সদাসতর্ক৷ পর্যটকদের নিরাপত্তা, সুরক্ষার পাশাপাশি কারও যাতে অন্যের অসুবিধা না-করে, সে ব্যাপারে আমরা সজাগ থাকছি৷' তিনি জানান, মূলত তিনটি পদক্ষেপ করা হচ্ছে৷ এক, এতদিন একটিমাত্র পুলিশ অ্যাসিস্ট্যান্স বুথ ছিল দিঘায়৷ আরও চারটি খোলা হচ্ছে ২৫ তারিখ থেকে৷ তিনটি বুথ থাকবে সৈকতে আর একটি থাকবে মেন রোডে৷ আরও দু'টি বুথ থাকবে মন্দারমণিতে৷ দুই, সব বুথে মজুত থাকবে প্রশিক্ষিত নুলিয়া৷ সমুদ্রস্নানের সময়ে অঘটন ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে তত্পরতা দেখাতে হাজির থাকবেন তাঁরা৷ এঁদের মধ্যে দিঘার সৈকতে ৩৩ জন ও মন্দারমণির সৈকতে ৭ জন নুলিয়া থাকবেন যাঁরা সকলেই অসামরিক প্রতিরক্ষা দন্তরের থেকে প্রশিক্ষণপ্রান্ত৷ আর তিন, পর্যটকদের গাড়ির ভিড় সামলাতে বিশেষ ট্র্যাফিক পুলিশিং ব্যবস্থা শুরু করা হচ্ছে যা আগে কখনও হয়নি দিঘায়৷ ডিএসডিএ-র প্রশাসক সুজন দত্ত জানান, দিঘা ও শঙ্করপুরের আলো, জল, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি পুর পরিষেবা তাঁরাই দেন৷ এ বার অতিরিক্ত ভিড়ের দিকে তাকিয়ে সে ব্যাপারে আরও জোর দেওয়া হচ্ছে৷ কারও যাতে কোনও অসুবিধা না-হয়, সেটা নিশ্চিত করাই লক্ষ্য৷ বড়দিনের পিকনিক পার্টিদের কথা মাথায় রেখে পুলিশ হলিডে হোম লাগোয়া পিকনিক স্পটে অস্থায়ী শৌচাগার ইতিমধ্যেই তৈরি করা হয়ে গিয়েছে৷
অনির্বাণ ঘোষ, দিঘা