কখনও যাত্রী প্রত্যাখ্যান, কখনও যাত্রীদের মারধর করে শিরোনামে আসছেন শহরের অটোচালকেরা৷ কিন্ত্ত অটোরিকশা নিয়ে চলতি একটি সমীক্ষা বলছে, সেটা সামগ্রিক ছবি নয়৷ কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণে বিভিন্ন অটো রুটের যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে সমীক্ষকেরা দেখেছেন, সাধারণ পরিবহণের মধ্যে নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যের বিচারে অটোকেই এগিয়ে রাখছেন যাত্রীরা৷ তবে বেশির ভাগ ঝামেলার সূত্রপাত যেখান থেকে, সেই খুচরো সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান এবং সে জন্য কিছু নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার বলেও মনে করছেন তাঁরা৷ তা ছাড়া, যখন-তখন ভাড়াবৃদ্ধি এবং পরিবেশগত সমস্যার কারণেও অটোর জনপ্রিয়তায় কিছুটা খামতি হচ্ছে৷ সে দিকে নজর দিয়ে অটো চালানোর ব্যাপারে প্রশাসনের আর একটু সক্রিয় ভূমিকা থাকলে ভালো হয় বলে মনে করছেন সমীক্ষকেরা৷কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর আর্বান ইকনমিক স্টাডিজ, দিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ এবং আইআইটি দিল্লির গবেষণাকেন্দ্র আই-ট্রান্স মিলে কেএমডিএ এলাকার ৪১টি মিউনিসিপ্যালিটিতে অটোরিকশা নিয়ে একটি সমীক্ষা চালাচ্ছে৷ এ বছর জুন মাসে শুরু হয়েছে সমীক্ষার কাজ, যার মধ্যে আছে কল্যাণী-বাঁশবেড়িয়া থেকে উলুবেড়িয়া-বজবজ পর্যন্ত এলাকা৷
কী দেখা গিয়েছে সেখানে? সেন্টার ফর আর্বান ইকনমিক স্টাডিজের প্রধান মহালয়া চট্টোপাধ্যায় জানান, শহরের বুকে সাধারণ পরিবহণের সমান্তরাল হিসেবেই চলছে অটোরিকশা৷ অনেকখানি দূরত্বও অটোয় যাতায়াত করতে পারেন শহরবাসী৷ সে জন্য তো বটেই, পাশাপাশি পরিবহণ হিসেবে অটোর সুযোগ-সুবিধাও অনেক বেশি বলে মনে করছেন নিত্যযাত্রীরা৷অটোর প্রতি আস্থার কারণগুলি এরকম-প্রথমত, অটো অনেক নিয়মিত৷ দ্বিতীয়ত, খুব সকাল থেকে বেশি রাত পর্যন্ত শহরের বেশির ভাগ রুটেই অটো মেলে৷ রাত বাড়লেই যেখানে বাসের জন্য হাপিত্যেশ করতে হয়, সেখানে অটো অনেক সহজেই পাওয়া যায়৷ তৃতীয়ত, বাসে ওঠানামার ঝক্কি, ছিনতাই-পকেটমারির আশঙ্কা, আসন পাওয়ার অনিশ্চয়তা অটোয় নেই৷ চতুর্থত, মেট্রোর রুটে বাসের তুলনায় অটোর চাহিদাই যাত্রীদের মধ্যে বেশি৷ দমদম থেকে কবি সুভাষ পর্যন্ত মেট্রো রুটে নেতাজি ভবন এবং কবি সুভাষ ছাড়া বাকি সব স্টেশনে নেমেই সামনে অটোস্ট্যান্ড৷ বেশির ভাগ মেট্রোযাত্রীর কাছেই এই যানটি বেশি গ্রহণযোগ্য৷ পঞ্চমত, সুবিধার তুলনায় অটোর ভাড়াও বেশ কম৷
তবে যাত্রীদের সঙ্গে অটোচালকদের বিরোধের অন্যতম কারণ হল খুচরো পয়সার সমস্যা৷ এই সমস্যা সমাধানে নিত্যযাত্রীদের জন্য মাসিক টিকিট চালু করার প্রস্তাব দেওয়ার কথা ভাবছেন সমীক্ষকেরা৷ তাঁরা জানান, কলকাতা শহরে ১২০টি মতো অটোর রুট আছে৷ যদিও তার কোনওটিই আইনি নয়৷ কারণ, পশ্চিমবঙ্গ পরিবহণ আইন অনুযায়ী অটোকে এ ভাবে নির্দিষ্ট রুটে ব্যবহার করার সংস্থান নেই৷ এটি ট্যাক্সির মতো কন্ট্র্যাক্ট ক্যারেজ হিসেবেই নথিভুক্ত৷ কাজেই রুটগুলির সবই অলিখিত৷ ফলে নির্দিষ্ট রুটের বেশি দূরত্বে বা কাটা রুটে অটো চালিয়ে যাত্রীদের হেনস্থা করেই থাকেন অটোচালকেরা৷ ইচ্ছেমতো বাড়ানো হয় ভাড়া৷ কিন্ত্ত কোনও হাত নেই বলে সরকার এ ব্যাপারে কিছু করতেও পারে না৷ বছর দুয়েক আগে একটি মামলায় হাইকোর্ট প্রশ্ন তুলেছিল, দেশের অন্যান্য শহরে মিটারে চললেও কলকাতায় অটো সে ভাবে চলে না কেন? সরকার তখন জানায়, হাইকোর্টের নির্দেশেই কলকাতায় অটো মিটারে চালানো হয় না৷
শিয়ালদহ-হাওড়া (যদিও ব্রিজের আগেই সেটি থামে), শোভাবাজার-উল্টোডাঙা, দমদম-চিড়িয়ামোড় রুটেই যাত্রীসংখ্যা সবচেয়ে বেশি হয় বলে আপাত ভাবে দেখা গিয়েছে৷ যদিও এই তথ্যের সমর্থনে হিসেব নেই সমীক্ষকদের কাছে৷ অটোর সংখ্যা কত, তা নিয়েও ধন্দ আছে৷কিন্ত্ত মফস্সলে অটো নিয়ে সমস্যা বেশ প্রকট৷ কারণ, ২০১০-এ কলকাতা থেকে যে সব টু-স্ট্রোক অটো বাতিল হয়েছিল, তার অনেকগুলিই এখনও কাটা তেলে চলছে শহরতলিতে৷ ফলে দূষণের সমস্যা সেখানে প্রকট হচ্ছে৷ মহালয়ার কথায়, 'শহরের দূষণ এ ভাবে শহরতলিতে পাঠিয়ে দেওয়াও তো ঠিক নয়৷ এ দিকে নজর দেওয়া জরুরি৷' গত সন্তাহেই বিষয়টি নিয়ে একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল৷ আরও কয়েকটি কর্মশালা ও গবেষণার মাধ্যমে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে এই সমীক্ষার কাজ সম্পন্ন হবে বলে সমীক্ষকদের আশা৷
saberee.g@timesgroup.com