নালসা রায়ে তৃতীয় লিঙ্গের সম্মান পেয়েও আইনি বাধায় একাধিক অধিকার থেকে এখনও বঞ্চিত রূপান্তরকারীরা৷
ঘটনা ১: বিশাখা একজন তথ্যপ্রযুক্তিকর্মী এবং রূপান্তরকামী৷ তিন বছর ধরে তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী কুশলের সঙ্গে সম্পর্ক তাঁর৷ একে অন্যের সঙ্গে একছাতার তলায় থাকলেও ৩৭৭ গেরোয় বিয়ে করতে পারেনি যুগল৷ ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট বিশাখা এবং তাঁরই মতো অন্য রূপান্তরকামীদের তৃতীয় লিঙ্গের সম্মান দিয়েছে৷ যুগল ভেবেছিল, দুই ভিন্ন লিঙ্গসত্ত্বার পরিচয় মেলায় এবার হয়তো বিয়ে করতে পারবেন তাঁরা৷ এ নিয়ে আইনজ্ঞের পরামর্শ নিতে গেলেই তিনি স্পষ্টভাষায় জানান, 'যতই তৃতীয় লিঙ্গকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারার পরিবর্তন হয়নি৷ তাই তোমাদের বিয়ে সম্ভব নয়৷'
ঘটনা ২: বিয়ে করতে না-পারলেও সন্তান তাঁর জীবনে আসুক, চেয়েছিলেন প্রণতি৷ তাই নিজের রূপান্তরকামীসত্তা প্রকাশ করেই চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির দ্বারস্থ হয়েছিলেন দত্তক নেওয়ার জন্য৷ তাঁকে হতাশ করে সিডব্লিউসি থেকে বলে দেওয়া হয়, 'আমাদের হাতে আইন নেই, যার বলে আমরা আপনাকে দত্তক দিতে পারি৷'
ঘটনা৩: ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছিলেন রঞ্জিতা সিনহা৷ গাড়ি চালানো জানলেও লাইসেন্স হাতে আসেনি রঞ্জিতার৷ কারণ? তিনি রূপান্তরকামী৷ মোটর ভেহিক্যালস কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, 'রূপান্তরকামী পরিচয়ে লাইসেন্স দেওয়ার আইন নেই৷'
রূপান্তরকামীদের আর পাঁচ জন 'স্বাভাবিক' মানুষের সমান অধিকার দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷ সত্তার স্বীকৃতি পেয়ে খুশির জোয়ারে ভেসেছিলেন তাঁরা৷ কিন্ত্ত দেড় বছর কাটলেও একাধিক অধিকার থেকে বঞ্চিতই থেকে গিয়েছেন তাঁরা৷ কারণ, সেই অধিকারকে বাস্তবে কার্যকর করতে যে সব আইনের পরিবর্তন দরকার, তার অধিকাংশই বদলায়নি৷ উপরের তিনটি ঘটনা তারই নিট ফল৷
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এটিএইচবি-র সদস্যা রাজ্য ট্রান্সজেন্ডার বোর্ডের সদস্য রঞ্জিতা সিনহার কথায়, 'সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আমাদের সমানাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে৷ সে ক্ষেত্রে বিয়ে করা, একজন লাইসেন্সধারী গাড়ি চালক হওয়া, একজন শিশুকে দত্তক নেওয়া এসবও তো আমার অধিকার৷ অথচ, এসব আমরা পাচ্ছি না৷'
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর রূপান্তরকামীরা ভিন্ন সত্তার অধিকারী৷ তা হলে কেন একজন অন্য লিঙ্গের ব্যক্তিকে (সে পুরুষ হোক বা মহিলা) বিয়ে করতে চাইলে আইন বাধা হয়ে দাঁড়াবে?
রূপান্তরকামীদের নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করা আইনজীবী কৌশিক গুপ্ত বলেন, 'হিন্দু বা স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী, শারীরিক সম্পর্ক বিবাহিত জীবনের একটা অঙ্গ৷ আর শারীরিক সম্পর্ক হলেই রূপান্তরকামী দম্পতি ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারার আওতায় চলে আসবেন (এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, নন-পিনোভ্যাজাইনাল ইন্টারকোর্স করা যে কোনও ব্যক্তিই এই আইনের আওতায় আসবেন)৷ সে ক্ষেত্রে যে কেউ অভিযোগ করলেই তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশি বন্দোবস্ত শুরু হবে৷' অতঃপর? বিয়ের অধিকার পেতে গেলে, ৩৭৭ ধারার সংশোধন প্রয়োজন৷
কিন্ত্ত সন্তান দত্তক নেওয়া বা গাড়ি চালানোর লাইসেন্স কেন পাবেন না তাঁরা? কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী সুস্মিতা সাহাদত্ত বলেন, 'হিন্দু অ্যাডপশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স অ্যাক্ট-ই বলুন বা গার্ডিয়ানল ওয়ার্ড অ্যাক্ট- দুটোতেই দত্তক দেওয়ার শর্ত হিসেবে দত্তকগৃহীতার পুরুষ বা মহিলা হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে৷ একই বিষয় লাইসেন্সের ক্ষেত্রেও৷ আইন না বদলালে কোনও পথ নেই৷'
সত্যিই কি নেই? কৌশিক কিন্ত্ত মনে করছেন না৷ পথ আছে আইনের মধ্যেই৷ তাঁর মত, 'হাসপাতালে আলাদা ওয়ার্ড, স্কুলে পড়ার সমান অধিকার কিংবা চাকরির ক্ষেত্রে সুযোগ- সেখানে আইন কোনও বাধা নয়৷ মানসিকতার পরিবর্তন বড় বাধা৷ কিন্ত্ত যে সব জায়গায় আইন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে আদালতেরই দ্বারস্থ হতে হবে৷ কারণ, যাঁরা আইনের কথা বলে একজন রূপান্তরকামীকে সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত করছেন, তিনি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের অবমাননা করছেন৷' আদালতের দ্বারস্থ হলে কি সমস্যার সমাধান হবে বিশাখা-প্রণতি-রঞ্জিতাদের?
Maitreyee.Bhattacharjee@timesgroup.com