বড় স্কুলে ভর্তির জন্য লক্ষ লক্ষ টাকার সংস্থান করার দুশ্চিন্তা তো আছেই৷ কিন্ত্ত তার বাইরেও খরচ কম নয়৷ নামী স্কুলে ভর্তি করার জন্য বাচ্চাকে তৈরি করতে হবে তো! ছোট-বড় নানা প্লে-স্কুলে ছেলে-মেয়েকে এক বার ঢোকাতে পারলে প্রস্ত্ততি নিয়ে চিন্তা অনেক কমে৷ সে জন্যও পকেটে রাখতে হবে লাখ খানেক-লাখ দেড়েক টাকা৷
বছর দশেক আগেও বড় প্লে-স্কুলের বেশির ভাগেরই ফি ছিল মাসে এক-দেড় হাজার টাকা৷ কিন্ত্ত এখন অ্যাডমিশন ও অন্যান্য ফি মিলিয়ে বছরে অঙ্কটা কম পক্ষে ৩০-৩৫ হাজারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে৷ স্কুলগুলিতে ভর্তি শুরু হয় দেড় বছর বয়সে৷ দেড় থেকে আড়াই বছর প্লে-গ্রুপ, আড়াই থেকে সাড়ে তিন নার্সারি, সাড়ে তিনের পর থেকে সাড়ে চার বছরে জুনিয়র কেজি, সাড়ে চারের পরে সাড়ে পাঁচ বছরের শিশুদের জন্য সিনিয়র কেজি--এই হল বয়স অনুযায়ী ক্লাসের বিন্যাস৷ অর্থাত্, বড় স্কুলে যাওয়ার আগে প্রত্যেক শিশুর জন্য তিন-চার বছরে লাখ খানেক-লাখ দেড়েক টাকা খরচ বাঁধা৷
বাচ্চাদের ১ থেকে ১০-২০ পর্যন্ত গুনতে শেখানো, রং চেনানো, ব্যাট-বলের পরিচিতি ঘটানোর মতো সাধারণ ব্যাপারও আর বাবা-মায়েরা বাড়িতে করানোর 'রিস্ক' নিচ্ছেন না৷ বড় স্কুলে ভর্তি নিশ্চিত করতে ছেলে-মেয়েকে 'স্মার্ট' করার জন্য প্লে-স্কুলগুলিই এখন শহুরে অভিভাবকদের অনেকের ভরসা৷ এবং সেখানেই শেষ নয়৷ অনেকে আবার দেড়-দুই-আড়াইয়ের শিশুকে প্লে-স্কুলের পরেও নিয়ে দৌড়চ্ছেন স্কুলের কোনও আন্টির বাড়িতে৷ সেখানেও মাসে এক থেকে দু'হাজার টাকা টিউশন ফি দিয়ে সেই একই খেলা-খেলা পড়া৷ প্রতিযোগিতা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে আধো বুলি ফোটার আগে টিউশনে যাওয়া, স্কুলে যাওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়ে যাচ্ছে শিশুদের৷
সল্টলেকের দম্পতি জাহ্নবী ও অমর দত্ত মেয়েকে কাঁকুড়গাছির একটি প্লে-স্কুলে ভর্তি করেছেন মাসিক দেড় হাজার টাকা খরচে৷ ভর্তি ও অন্যান্য খাতে বছরে হাজার তিরিশেক টাকা খরচ অবধারিতই৷ শিশুটির মা নিজে স্কুল-শিক্ষিকা৷ প্লে-স্কুলে কেন? যুবতীর কথায়, 'বাড়ির পরিবেশের সঙ্গে স্কুলের পরিবেশের অনেক তফাত৷ মেয়েকে সেই পরিবেশের জন্য তৈরি করতে হবে৷ সে জন্যই প্লে-স্কুলে নিয়ে যাওয়া৷' রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের জয়তী ও দেবনারায়ণ দে-র চার বছরের ছেলে সম্প্রতি একটি নামী আইসিএসই স্কুলে ভর্তি হয়েছে৷ দে-দম্পতিও ছেলেকে বালিগঞ্জের কাছে একটি প্লে-স্কুলে ভর্তি করেছিলেন৷ গৃহবধূ জয়তীর বক্তব্য, 'ছেলে এমনিতে দুষ্টুমি করলেও বাইরের লোক দেখলে একেবারে গুটিয়ে যেত৷ প্লে-স্কুলে গিয়ে ওর সেই সমস্যা অনেকটা কেটেছে৷'
রং চেনানো, আশপাশের জিনিসের (যেমন, ফল-ফুল-গাছপালা) সঙ্গে পরিচয় ঘটানো, গুনতি, অক্ষর পরিচিতি, কিছু কিছু হাতের কাজ, কিছু রাইম্স--খেলার মাধ্যমে এ সবই শেখানো হয় শিশুদের৷ স্কুল শেষে টিউশনে এগুলোরই ঝালাই চলে৷ হয়তো বাড়তি কয়েকটি রাইম্স বা একটু বেশি সংখ্যার গুনতি যোগ হয় সেখানে৷ আর খাতায়-কলমে লেখার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় কথা বলা, হাতের কাজ- এগুলির উপরে৷
এ ব্যাপারে কী বলছে বড় স্কুলগুলি?
ভারতীয় বিদ্যা ভবনের অধ্যক্ষা অনিন্দিতা চট্টোপাধ্যায় বলেন, 'শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী শিশুদের ইন্টারভিউ নেওয়া যায় না৷ আর ছোট ছোট বাচ্চাদের কী-ই বা জিজ্ঞেস করব? ওই নিজের নাম জানে কি না, কিছু রং চেনে কি না--সে সবই দেখা হয়৷ তবে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলা হয়৷ তাঁদের মানসিকতাটা একটু বুঝে নেওয়া হয়৷' অনেকটা একই কথা জানান এপিজে স্কুলের রিতা চট্টোপাধ্যায়৷ ফিউচার ফাউন্ডেশনের রঞ্জন মিত্রের বক্তব্য, 'ভর্তির সময় কোনও পরীক্ষা নেওয়া হয় না ঠিকই৷ তবে একটু কথা বলে তো দেখে নিতেই হয় যে বাচ্চা কতটা প্রস্ত্তত৷ শিক্ষার অধিকার আইনেও 'লার্নিং রেডিনেস' বুঝে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে৷ কিছু প্রশ্নের মাধ্যমে সেটাই দেখে নেওয়া হয়৷'
আর সে সব প্রশ্নের মেড-ইজির সন্ধান থেকেই বাড়বাড়ন্ত প্লে-স্কুলের!
সাবেরী প্রামাণিক