চিকিত্সা বিজ্ঞানের সুপার-স্পেশ্যালিটি শাখায় দিনভর ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি কবি হিসেবেও সাহিত্য জগতে তাঁর সাবলীল বিচরণ দেখে আজও বিস্মিত অনেকেই৷ স্বাস্থ্য মহলে তিনি বিএন গুহরায় হিসেবে পরিচিত হলেও সাহিত্য জগতে তাঁর নামডাক ছিল ভূমেন্দ্র গুহ হিসেবেই৷
কলকাতায় হূদশল্য চিকিত্সার ক্ষেত্রে ভূমেন্দ্রবাবুর অসামান্য অবদান বরাবর স্বীকার করেন চিকিত্সকরা৷ ১৯৬২ সালে ভারতবর্ষের প্রথম সফল ওপেন হার্ট সার্জারিটি হয়েছিল কলকাতায়৷ বিখ্যাত হূদশল্য চিকিত্সক অজিত কুমার বসুর ছাত্র ও সহকারী হিসেবে সেই অস্ত্রোপচারে ছিলেন তিনিও৷ দীর্ঘ লড়াইয়ের পর, তাঁর হাত ধরেই কার্ডিয়োভাস্কুলার থোরাসিক সার্জারি (সিভিটিএস) র মতো একটি সুপার-স্পেশ্যালিটি বিভাগ চালু হয় মেডিক্যালে৷ পরবর্তী সময় এই বিষয়ে পঠনপাঠন চালু করার কৃতিত্বও তাঁকেই দেন সমসাময়িক চিকিত্সকরা৷
তাঁর প্রিয় ছাত্র তথা রাজ্য স্বাস্থ্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন প্লাবন মুখোপাধ্যায় বলেন, 'জীবনের শেষ সময়ে স্যর ভর্তি ছিলেন এমন একটা জায়গায়, যা তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিল৷ মেডিক্যালের ডেভিড হেয়ার ব্লকের সিভিটিএস তৈরি করেছিলেন উনিই৷ তারই অধীন ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটেই স্যর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন৷'
তবে চিকিত্সক বি এন গুহরায়ের সাফল্যকে কোনও কোনও অংশে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন কবি ও সাহিত্যিক ভূমেন্দ্র গুহ৷ ১৯৩৩ সালে বিলাসপুরে জন্ম তাঁর৷ কবিতা লেখার শখ ছিল ছোট থেকেই৷ ছাপার অক্ষরে প্রথম কবিতা বেরোয় 'পুবের অক্ষর' নামে একটি হাতে লেখা স্কুল ম্যাগাজিনে৷ তারও পরে 'মৌচাক' পত্রিকাতেও কবিতা লিখেছেন তিনি৷ ১৯৫২ 'পূর্বাশা' পত্রিকায় তাঁর প্রথম প্রেমের কবিতা ছাপা হয়৷ ওই বছরই প্রকাশ হওয়া 'ময়ূখ' পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি৷ পরবর্তীকালে 'শতভিষা', 'কৃত্তিবাস'-এর মতো পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হয় তাঁর কবিতা৷
ময়ূখ পত্রিকা প্রকাশের সূত্রেই জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে তাঁর আলাপ৷ জীবনানন্দের মৃত্যুর স্মৃতিতে 'ময়ূখ' পত্রিকাটিও সম্পাদনা করেন তিনি৷ জীবনানন্দের অসংখ্য অপ্রকাশিত কবিতা, প্রবন্ধ, দিনলিপি ও ছোটগল্পের পাশাপাশি তাঁর উপন্যাসগুলি খুঁজে বের করার কৃতিত্বও ভূমেন্দ্রবাবুরই৷ সম্প্রতি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদিত জীবনানন্দের কবিতা সমগ্র৷ তাঁর জীবনের শেষ ইচ্ছা ছিল জীবনানন্দের রচনাবলির কাজ সম্পূর্ণ করা৷ সেই ইচ্ছা অপূর্ণই রইল৷
১৯৫৯ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত শুধু ডাক্তারি করেছেন তিনি, লেখার সময় পাননি৷ অবসরের পর 'দরগা রোড' নামে একটি কবিতা পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক হন৷ ১৯৯৪ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই প্রকাশ হয়, নাম 'যম'৷ এর পর লিখেছেন 'ঋতুচক্র', 'পিতামহ', 'বেলাশেষের অতিকথন'-এর মতো মোট ১১টি কবিতাগ্রন্থ৷ অনুবাদ করেছেন র্যাঁবোর 'নরকে এক ঋতু'৷
১৯৫২ সালে অনুবাদ করেন সাফো৷ প্রচুর অনুবাদ, প্রবন্ধ, গল্প ছাড়াও লিখেছেন দু'টি উপন্যাস৷ ২০০৫ সালে পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার৷ গত ৩০ নভেম্বর তাঁর শেষ বই, দুই খণ্ডে 'ভূমেন্দ্র গুহর কবিতা' প্রকাশ হয়৷ তাঁর মৃত্যুতে এক বিরল প্রতিভাকে হারাল বাঙালি৷
এই সময়: প্রয়াত বিশিষ্ট চিকিত্সক, প্রথিতযশা কবি ও সাহিত্যিক ভূমেন্দ্রনাথ গুহরায়৷ বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন তিনি৷ রবিবার ভোর রাতে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে মৃত্যু হয় ৮৩ বছরের এই বরেণ্য চিকিত্সকের৷ দিন চারেক আগে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন হাসপাতালে৷ প্রবীণ এই হূদশল্য চিকিত্সকের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে চিকিত্সকমহলের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও৷