২০১২ সালের বিক্ষোভে জলকামান থেকে লাঠিচার্জ, সবেরই আশ্রয় নিয়েছিল দিল্লি পুলিশ৷ এ বার সেই উচ্চতায় না গেলেও দিল্লি পুলিশের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ তুলেছেন জ্যোতির মা আশা দেবী৷ তাঁর হাত থেকে রক্ত পড়ার ছবি ধরা পড়ে টিভির ক্যামেরায়৷ অভিযোগ, বিক্ষোভ দেখানোর সময় পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতেই আহত হয়েছেন তিনি৷ ইন্ডিয়া গেট থেকে যখন তাঁদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি৷ বলেন, 'যাকে জেলে ঢোকানো উচিত ছিল সে আজ মুক্তি পাচ্ছে৷ আর তার বদলে আমরা, যাদের সঙ্গে অন্যায়টা ঘটেছে, তাদেবই তাড়িয়ে বেড়ানো হচ্ছে৷ প্রথমে যন্তর মন্তরে গেছিলাম, সেখানে বিক্ষোভ দেখাতে দেওয়া হল না৷ এ বার ইন্ডিয়া গেট থেকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷' শনিবার রাতের বিক্ষোভ থেকেও একই ভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁদের৷ আশা এ দিন বার বার বলছিলেন, 'আজ আমি কিছুতেই বাসে উঠব না৷' তবে তাতে লাভ হয়নি৷ এক রকম জোর করেই বাসে চাপিয়ে তাঁদের মুখার্জি নগর থানায় নিয়ে আসে পুলিশ৷ ক্ষোভে ফেটে পড়ে জ্যোতির বাবা বদ্রীনাথ বলেন, 'মুক্তির ব্যাপারে তো আমরা অসহায়৷ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে লাঠির মার না খেলে তো আমাদের সরকার, সে কেন্দ্র হোক বা রাজ্য, কারও কথাই শুনতে পায় না৷ সবাই জানত ওকে ছেড়ে দেওয়া হবে৷ তিন বছরে কেন কেউ কোনও ব্যবস্থা নিল না?'
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকেও এ দিন তুলোধোনা করেছেন আশা ও বদ্রীনাথ৷ আশার কথায়, 'আর কতগুলো ধর্ষণ, কতগুলো খুন হলে সরকার জুভেনাইল জাস্টিস আইনে বদল আনবে? আমরা মোদীজির সঙ্গে শুধু ২ মিনিট কথা বলতে চাই৷' দিল্লি মহিলা কমিশনের শেষ মুহূর্তের তত্পরতাকে 'দেখনদারি' আখ্যা দিয়েছেন তাঁরা৷ প্রশ্ন তুলেছেন, হাইকোর্টের রায় তো ২-৩ দিন আগেই এসে গিয়েছিল৷ মহিলা কমিশন এত দেরি করল কেন ব্যবস্থা নিতে? এই অভিযোগের সাফাই দিয়ে স্বাতী মালিওয়ালের এ দিন বক্তব্য, আইনি পরামর্শ নিতে নিতেই দেরি হয়ে গিয়েছিল৷এ দিন সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ 'গোপন' জায়গা থেকে বর্তমানে ২১ বছর বয়সি ওই যুবককে মুক্তি দেওয়া হয়৷ দিল্লি হাইকোর্ট তার মুক্তিতে স্থগিতাদেশ দিতে অস্বীকার করার পর দিনই 'নিরাপত্তাজনিত কারণে' তাকে ওই গোপন জায়গায় সরানো হয়েছিল৷ সূত্রের খবর, তাকে বেছে নিতে বলা হয়েছিল, সে উত্তরপ্রদেশের বদায়ুনে নিজের বাড়িতে ফিরে যাবে, না হোমের পুনর্বাসন কমিটি প্রস্তাবিত এনজিও-র অধীনে থাকবে৷ সে এনজিও-টির সঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷
শনিবার মাঝরাতে তার মুক্তি আটকানোর জন্য শেষ মুহূর্তের চেষ্টায় সুপ্রিম কোর্টে স্পেশাল লিভ পিটিশন দাখিল করতে যান স্বাতী৷ কিন্ত্ত সুপ্রিম কোর্ট ওই অপরাধীর মুক্তিতে স্থগিতাদেশ দিতে রাজি হয়নি৷ তবে বিষয়টি বিশেষ ভ্যাকেশন বেঞ্চের সামনে শুনানির জন্য সোমবারের তারিখ দেওয়া হয়৷ এই রায়ের পর রাত দেড়টা নাগাদ প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুরের বাড়ি গিয়ে হাজির হন এই মামলার সঙ্গে যুক্ত দুই আইনজীবী গুরু কৃষ্ণ কুমার এবং দেবদত্ত কামাত৷ রবিবার সকালে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ড, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং প্রধান বিচারপতি টিএস ঠাকুরকে লেখা চিঠিতে মালিওয়াল জানান, যেহেতু শনিবার রাতে ওই এসএলপি দাখিল করা হয়েছে, কাজেই নাবালকের মুক্তির বিষয়টি এখন বিচারাধীন৷ কাজেই ওই মুক্তি স্থগিত রাখা হোক৷ কামাত জানিয়েছেন, এসএলপি-টিতে হাইকোর্টের রায়ের কিছু ভুলভ্রান্তি তুলে ধরা হয়েছে৷ কেন্দ্র হাইকোর্টে জানিয়েছিল যে ওই অপরাধীর মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়নি, অথচ এই প্রক্রিয়া অবশ্যপালনীয়৷ হোমে থাকাকালীন সে যে তার এই জঘন্য অপরাধের জন্য কোনও রকম অনুশোচনা দেখায়নি বরং ধর্মীয় চরমপন্থায় প্রভাবিত হয়েছিল, তারও গোয়েন্দা রিপোর্ট রয়েছে বলে হাইকোর্টকে জানায় কেন্দ্র৷ কিন্ত্ত এ ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রক্রিয়া জরুরি মেনে নিয়েও মুক্তিতে স্থগিতাদেশ দেয়নি হাইকোর্ট৷ এই বিষয়টি এসএলপি-তে তুলে ধরা হয়েছে বলে জানান তিনি৷ কিন্ত্ত কিছুতেই কিছু হয়নি৷
এই ঘটনা নিয়ে যথারীতি পরস্পরের ঘাড়ে দায় চাপানোর খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে৷ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু এ দিন স্পষ্ট করে দেন, ওই অপরাধীর পুনর্বাসনের কমিটি নির্বাচন থেকে শুরু করে গোটা প্রক্রিয়াই ছিল দিল্লি সরকারের হাতে৷ তারাই ১০ হাজার টাকা ও সেলাই মেশিন 'উপহার' দিয়ে ওই অপরাধীকে নতুন জীবন শুরু করতে দিয়েছে৷ বিজেপির তরফে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, জুভেনাইল জাস্টিস আইন সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় বিল লোকসভায় পাশ হয়ে গেলেও রাজ্যসভায় আটকে গিয়েছে বিরোধী আপত্তির কারণেই, এবং সেখানে দিল্লির শাসক দল আম আদমি পার্টির সাংসদরাও আপত্তি জানিয়েছিলেন৷ আসরে নেমেছে কংগ্রেসও৷ দলীয় নেতা সন্দীপ দীক্ষিত এ দিন বলেন, 'দিল্লি সরকার আর দিল্লি মহিলা কমিশন তো অনেক দিন ধরেই আছে৷ যদি তাদের মনে হয় যে এক জনকে মুক্তি দেওয়া অনুচিত, তা আটকানোর যথেষ্ট সময় ছিল৷ কিন্ত্ত যখন এটা মানুষের আবেগের প্রশ্ন হয়ে উঠল তখন তারা এটা নিয়ে রাজনীতি শুরু করে দিল৷' কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সিং সুরযেওয়ালা আবার প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, 'ওই নৃশংস গণধর্ষণের অপরাধীকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে৷ মোদী কি এতেও নজর দেবেন না? এ ধরনের অপরাধ যাতে আর না ঘটে তা কি দেখা হবে না?'
এই সময়, নয়াদিল্লি: ২০১২ সালের ডিসেম্বরে তাঁর উপর নৃশংসতার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিল দিল্লি৷ ঠিক তিন বছর পর ফের জ্যোতি সিং পাণ্ডের স্মৃতিতে উত্তাল হল ইন্ডিয়া গেট৷এ বারের প্রতিবাদ জ্যোতির অত্যাচারীকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য৷ সে ক্ষোভ হতাশায় বদলে যেতে সময় লাগেনি৷ শনিবার মাঝ রাতে সুপ্রিম কোর্টে স্পেশ্যাল লিভ পিটিশন (এসএলপি), মহিলা কমিশন প্রধানের তরফে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি, জ্যোতির বাবা-মা সহ শতাধিক বিক্ষোভকারীর ধিক্কার, কোনও কিছুতেই আটকাল না ১৬ ডিসেম্বর গণধর্ষণের নাবালক অপরাধীর মুক্তি৷পশ্চিমবঙ্গের অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্র বলেন, 'আইন যখন বলছে ওই ছেলেটির মুক্তি পাওয়া উচিত, তখন তাঁকে ছেড়ে দিতে হবে৷ কিন্ত্ত, যদি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বলতে বলেন তা হলে, সে যে অপরাধ করেছে, তার দিকে তাকিয়ে বলব আইনের কোনও না কোনও ধারা প্রয়োগ করে ছেলেটিকে মুক্ত হওয়া থেকে আটকানো দরকার৷ যে পাশবিক অপরাধ ছেলেটি করেছে গত তিন বছর কারেকশনাল হোমে থেকে তাঁঁর সেই মানসিকতার আদৌ কোনও পরিবর্তন হয়েছে কি না তা আমরা কেউই জানি না৷ আমি মনে করি, এই তিন বছরে হোমে ওর ব্যবহার কেমন ছিল, আদৌ তার মনোবৃত্তির পরিবর্তন হয়েছে কিন সে সংক্রান্ত রিপোর্ট এ ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখা উচিত৷'একই কথা বলছে দিল্লির মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন স্বাতী মালিওয়ালের ফাইল করা স্পেশাল লিভ পিটিশনও৷ কিন্ত্ত আজ, সোমবার এসএলপি-র শুনানিতেও এই সিদ্ধান্ত বদলানোর সম্ভাবনা প্রায় শূন্য৷ আইন বলছে, যেহেতু অপরাধের সময় ওই যুবক নাবালক ছিল, তাই এখন প্রান্তবয়স্ক অবস্থায় নতুন কোনও অপরাধ না করলে পুরোনো অপরাধের ভিত্তিতে তাকে আর গ্রেন্তার করা যাবে না৷ এটি সংবিধানে সংরক্ষিত অধিকার৷