অবশেষে সাক্ষাত্ হল দু'জনের৷ ১১ মাসের ব্যবধানে৷ সে সাক্ষাত্ গড়াল নৈশভোজ পর্যন্ত!
দু'জন কে কে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর মুকুল রায়!
দু'জনের প্রথম সাক্ষাত্টা হয়েছিল বৃহস্পতিবার সংসদের সেন্ট্রাল হলে৷ আচমকা৷ আর দ্বিতীয়টা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলোয়, নৈশভোজে৷ রাত পৌনে এগারোটার সময় মমতা নিজেই ফোন করে ডিনারে ডাকলেন মুকুলকে৷ শুধু তাই নয়, ডেরেক ও'ব্রায়েনকে পাঠানো হল লাগোয়া বাংলো থেকে মুকুলকে নিয়ে আসতে৷ বৃহস্পতিবার বেশি রাত পর্যন্ত নৈশভোজ আর দলনেত্রীর সঙ্গে আড্ডাতেই ব্যস্ত রইলেন মুকুল৷
তার আগে এ দিন দুপুরে সংসদের সেন্ট্রাল হলে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে সঙ্গে নিয়ে বসেছিলেন মমতা৷ তাঁদের বৃত্তাকারে ঘিরে ছিলেন তৃণমূল সাংসদরা৷ এই অবস্থায় ভিড় ঠেলে একগাল হেসে উপস্থিত মুকুল রায়৷ তাঁকে দেখেই মমতা বললেন, 'এই যে মুকুল৷' সামনে ঝুঁকে পড়ে হাসিমুখে নমস্কার করলেন মুকুল৷ দলনেত্রী জানতে চাইলেন, 'কী খবর? কেমন আছ?' এ ভাবেই এগারো মাস পর দলনেত্রীর সঙ্গে একদা তাঁর সবথেকে আস্থাভাজন নেতার দেখা হল৷ পাশে বসা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে দেখিয়ে মমতা অতঃপর মুকুলকে বললেন, 'কেজরিওয়ালজি বললেন, কখনও সেন্ট্রাল হল দেখেননি৷ আমি বললাম, চলুন আমার সঙ্গে৷' কেজরিওয়ালের সঙ্গে অবশ্য পরিচয় করিয়ে দিলেন শুধু মুকুল রায় বলেই৷ কেজরিকে নমস্কার করলেন একদা তৃণমূলের দু' নম্বর ব্যক্তিত্ব৷ মুখ্যমন্ত্রী টোস্টের প্লেট এগিয়ে দিলেন মুকুলের দিকে৷ সেখান থেকে একটা টোস্ট হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন মুকুল রায়৷ মেরে-কেটে তিরিশ সেকেন্ডের সাক্ষাত্কার!
দুপুরে ও রাতে এই জোড়া সাক্ষাতের গুরুত্ব অপরিসীম৷ কারণ, সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআইয়ের জেরার মুখে পড়ার পর থেকে মমতা ও মুকুলের মধ্যে দূরত্ব কেবলই বেড়েছে৷ রাজ্যসভায় প্রথম সারি থেকে মুকুলের জন্য আসন বরাদ্দ হয়েছে শেষের আগের সারিতে৷ দলীয় সব দায়িত্ব ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে৷ সেই সবের পর বৃহস্পতি আবার দেখা হল দু'জনের৷
তবে এটা মনে করাটা কষ্টকল্পনা হবে যে, সেন্ট্রাল হলের প্রথম সাক্ষাত্টা ছিল একেবারেই আচমকা৷ কারণ, মমতা-মুকুল দূরত্বের পর দিল্লিতে বেশ কয়েকবার এসেছেন তৃণমূল নেত্রী৷ দিল্লি এলে মুখ্যমন্ত্রী এখন যেখানে ওঠেন, সেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি এবং মুকুল রায়ের বাংলো একেবারে পাশাপাশি৷ মুকুলের বাংলোর বেড়ার গায়ের গেট ঠেলে বেরিয়ে এলেই অভিষেকের বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া যায়৷ কিন্ত্ত একবারের জন্যও গেট ঠেলে বেরিয়ে দলনেত্রীর সঙ্গে দেখা করার তাগিদ দেখাননি মুকুল৷ গতবার মুখ্যমন্ত্রী যখন দিল্লি এসেছিলেন, তখন মুকুল চলে যান কলকাতায়৷ এ দিন কিন্ত্ত তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই চলে গেলেন দলনেত্রীর কাছে৷
আর এই যাওয়াটাই নানা প্রশ্ন উস্কে দিচ্ছে৷ তৃণমূল মহলের প্রশ্নটা হল, তা হলে কি এই সাক্ষাত্ এত দিন পরে মুকুলের দলে আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ খুলে দিল? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে অবশ্য মুকুলের সঙ্গে সাক্ষাত্কে গুরুত্ব দিতে চাইছেন না৷ তিনি শুধু বলেছেন, 'হ্যাঁ, মুকুলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল৷ ও দলের সাংসদ৷ সব সাংসদের সঙ্গেই আমার দেখা হয়েছে৷' কলকাতায় তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'কুশল বিনিময় আর রাজনীতি এক নয়৷ বুদ্ধদেববাবুও আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কেমন আছ? তা বলে আমি কী সিপিএম হয়ে গেলাম? মুকুল এখনও দলের রাজ্যসভা সাংসদ৷ দলনেত্রীর সঙ্গে দেখা হওয়ায় কুশল বিনিময় হয়েছে৷ আপনারাই একবার বলছেন, ও অন্য দলে যাচ্ছে৷ আবার কখনও অন্য দল গড়ছে৷ এখন আবার বলছেন, ও দলেই থাকবে! আপনাদেরই ঠিক করতে হবে, আপনারা কোনটা বলবেন৷' আর দলনেত্রীর সঙ্গে দেখা করে জল্পনা উস্কে দেওয়া মুকুল নিজে বলছেন, 'এটা নিছক সৌজন্য সাক্ষাত্কার৷ ধূমপানের জন্য বাইরে যাচ্ছিলাম৷ বাইরে যেতে গেলে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে দিয়ে যেতে হত৷ তাই গেলাম৷ দেখা হল৷ এটা তো বাংলার চিরকালীন সৌজন্য, বাংলার কৃষ্টি৷ আর এটা তো ঠিক, উনি আমার দলনেত্রী৷ এত দিন ধরে দলের সব নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি৷ হুইপ মেনে ভোট দিয়েছি৷' কথা হল, সেই কৃষ্টির নমুনা এত দিন ধরে কেন দেখা যায়নি? এগারো মাস পর সংসদের সেন্ট্রাল হলেই সেটা দেখা গেল কেন? নৈশভোজে আমন্ত্রণ ও আমন্ত্রণরক্ষা নিয়ে অবশ্য কোনও পক্ষেরই প্রতিক্রিয়া মেলেনি৷
তবে এটাও ঠিক যে, চাইলে দেখা না-ও করতে পারতেন মুকুল৷ যেমন, এ দিন সেন্ট্রাল হলে ঢুকে মমতা যখন তৃতীয় সারির আসনে কেজরিওয়ালকে নিয়ে বসলেন, তখন সেখানেই একদিকে বসেছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী ও কংগ্রেস সাংসদ এ এইচ খান চৌধুরী৷ মুখ্যমন্ত্রীকে দেখে তাঁরা চুপচাপ অন্য দিকে সরে যান৷ মমতা অবশ্য তাঁদের খেয়ালও করেননি৷ মুকুল কিন্ত্ত সেই কাজ করেননি৷ তিনি জানতেন দলনেত্রী কখন আসবেন৷ সেই সময় তিনি সেন্ট্রাল হলে ছিলেন এবং এসে সাক্ষাত্ করে গিয়েছেন৷ পরে অবশ্য তিনি বারবার বলেছেন, এটা নিছকই সৌজন্য৷ তার পর নিজেই জানিয়েছেন, তিনি বুধবার প্রধানমন্ত্রীর অফিসে গিয়েছিলেন৷ নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করার সময় চেয়েছেন৷ তিনি যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন ইছাপুর কোচ ফ্যাক্টরির কাজ শুরু করতে চেয়েছিলেন, কিন্ত্ত তা আটকে রয়েছে৷ ফুরফুরা শরিফে রেলসংযোগের কাজও এগোচ্ছে না৷ সেই সব কাজে গতি আনার জন্যই তিনি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবেন৷ পাছে এই সাক্ষাত্ নিয়ে অযথা জল্পনা হয়, তাই আগে থাকতে নিজেই জানিয়ে দিলেন৷
কয়েক দিন আগেই দলের কয়েকজন প্রভাবশালী সাংসদের সঙ্গে সেন্ট্রাল হলে কথা বলতে দেখা গিয়েছে মুকুলকে৷ ডেরেক তাঁর সঙ্গে স্যুপ খেয়ে টুইট করেছেন৷ কয়েক মাস আগেও এই ছবি কল্পনা করা যেত না৷ তখন মুকুল ছিলেন ব্রাত্য৷ এ দিন মমতার সঙ্গে সাক্ষাত্ এবং নৈশভোজ কিন্ত্ত প্রশ্ন তুলে দিল, হাওয়া কি কিছুটা হলেও ঘুরছে?
গৌতম হোড়, নয়াদিল্লি